শিবশংকর সূত্রধর, কোচবিহার: কোচবিহারের (Cooch Behar) দিঘিগুলির জীববৈচিত্র্য বদলে যাওয়ায় মোহনের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। দিঘিতে আবর্জনা জমায় সেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। আগাছার পরিমাণ বেশি হওয়ায় সেখানে মানিয়ে নিতে মোহনদের সমস্যা হচ্ছে। দিঘি ও সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ তাদের বংশবৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেদিকে প্রশাসনের কোনও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না বলেই অভিযোগ। পথ দুর্ঘটনা, পাচার তো রয়েছেই, পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য বদলের কারণে মোহনের সংখ্যা কমতে থাকায় পরিবেশপ্রেমীরাও উদ্বিগ্ন। এখনই সদর্থক কোনও ভূমিকা না নিলে এটি আগামীতে হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নেচার অ্যান্ড স্টাডি গ্রুপের সম্পাদক তথা পরিবেশপ্রেমী অরূপ গুহর কথায়, ‘যেখানে মোহন থাকে সেই দিঘিগুলির জলের নিয়মিত পরীক্ষা করা প্রয়োজন। প্রতিটি কাজ বিজ্ঞানসম্মত না হলে মোহন বাঁচানো যাবে না। দিঘির জল যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে মোহনরা সংকটের মধ্যেই রয়েছে।’ মোহন বিশেষজ্ঞ তথা কোচবিহারের ভেটেরিনারি অফিসার ডাঃ রাজীবকান্তি সাহার পরামর্শ, ‘কোচবিহারের মোহনগুলি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। তাই এগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য। দিঘিতে অক্সিজেন (Oxygen) কমে গেলে মোহন নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সেজন্য দিঘির জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা সঠিক রাখতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের পাশাপাশি ফোয়ারা লাগানো প্রয়োজন। তাতে জলে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়বে।’ বাণেশ্বরের মোহন প্রসঙ্গে কোচবিহার-২ এর বিডিও বিশ্বজিৎ মণ্ডল বলেছেন, ‘বাণেশ্বরের শিবদিঘি পরিষ্কার, সংস্কার সহ মোহন বাঁচাতে বিভিন্ন কাজ করা হয়েছে। আরও কাজ করা হবে।’
কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বাণেশ্বরে সবচেয়ে বেশি মোহন রয়েছে। সেখানকার শিবদিঘির পাশাপাশি ওই এলাকার প্রায় প্রতিটি জলাশয়েই মোহনের দেখা মেলে। শুধু তাই নয় কোচবিহারের সাগরদিঘি, রাজমাতাদিঘি সহ বেশ কয়েকটি দিঘিতেও মোহনের দেখা মেলে। কিন্তু বাণেশ্বরের শিবদিঘিতে দূষণ কমাতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাকি দিঘিতে দূষণ রোধে সেরকম কোনও ব্যবস্থা দেখা যায় না। দিঘিগুলিতে আবর্জনা জমায় সেখানকার জীববৈচিত্র্য বদলে যাচ্ছে। ‘ব্ল্যাক সফট শেল টার্টেল’ প্রজাতির এই কচ্ছপগুলি স্থানীয়ভাবে ‘মোহন’ বলেই পরিচিত। বিশ্বের হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি জায়গাতেই এই প্রজাতির কচ্ছপ মেলে। কোচবিহার জেলা প্রশাসনের ম্যাসকটে মোহনের ছবি ব্যবহার হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে মোহনের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। মোহন বাঁচাতে বিশেষজ্ঞরা একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও প্রশাসন কার্যত উদাসীন।
গত দু’বছরে কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার রাজ্য সড়কে শুধুমাত্র পথ দুর্ঘটনাতেই ৫২টি মোহনের মৃত্যু হয়েছে। যার অধিকাংশ দুর্ঘটনা রাতে ঘটেছে। মোহনের গায়ের রং ও রাস্তার রং প্রায় একই হওয়ায় রাস্তা পারাপারের সময় সহজেই চালকরা মোহনের উপস্থিতি বুঝতে পারেন না। সেজন্য বউটি ব্রিজ থেকে ঘরঘরিয়া ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তাকে ‘মোহন করিডর’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা, পথবাতি ও স্পিডব্রেকার বসানোর দাবি উঠেছে। বাণেশ্বরের বাসিন্দা সুভাষ সরকার বললেন, ‘আমরা মোহনকে ভগবানের চোখে দেখি। পথ দুর্ঘটনায় যখন মোহন মারা যায় তখন আমাদের চোখে জল চলে আসে। পুলিশের তরফে ধীরে যানবাহন চালানোর কিছু বোর্ড লাগানো হয়েছে। সেরকম আরও বোর্ড লাগানো প্রয়োজন।’ আরেক বাসিন্দা সুধাংশু দাসের বক্তব্য, ‘ছোটবেলায় দিঘিগুলিতে যে সংখ্যায় মোহন দেখতাম এখন তা দেখা যায় না। মোহন সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের পদক্ষেপ করা উচিত।’ মোহনের সংখ্যা কমায় পাচারের তত্ত্বও সামনে এসেছে। মোহন রক্ষা কমিটির সম্পাদক রঞ্জন শীলের অভিযোগ, ‘এর আগেও এখান থেকে অনেক মোহন অসমে পাচার হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। মাঝেমধ্যেই পাচারের খবর পাওয়া যায়।’
মোহন রক্ষার জন্য বাণেশ্বরের শিবদিঘির চারদিকে মাটি দিয়ে পাড় বাঁধানো হয়েছে। অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সেখানে ফোয়ারা বসানো হয়েছে। মোহন সুরক্ষা বাহিনী তৈরি করে রাস্তাগুলিতে নজরদারিও চালানো হয়। পুলিশের তরফে রাস্তায় গার্ডরেল বসানো হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোহন বাঁচাতে জলাশয়ের স্বাস্থ্যের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত। বাণেশ্বরের বহু ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাশয়েও মোহন রয়েছে। প্রশাসনিক উদ্যোগ নিয়ে সেই জলাশয়ের স্বাস্থ্যের দিকেও পদক্ষেপ করা প্রয়োজন।