অভিরূপ দে, ময়নাগুড়ি: পাড়ার টুম্পা বৌদি হোক বা অমিতাভ বচ্চন বা অনেকটা দূরে ইংল্যান্ডে রাজার বাড়ি। শাশুড়ি-বৌমার সম্পর্ক যে কতটা ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ হতে পারে তা এই পরিবারগুলি জানে বিলক্ষণ। বহু চেষ্টা চালালেও বেশিরভাগ পরিবারে এই সম্পর্ক সেভাবে সহজ হয়নি। দুজনের মধ্যে মনকষাকষির সুবাদে পাল্লা নিয়ে তিক্ততা বেড়েছে। ময়নাগুড়ি শহরের সুভাষনগরপাড়ায় অবশ্য অন্য গল্প। শাশুড়ি ডলি বিশ্বাসকে নিজের লিভার বা যকৃতের অংশ দান করে বৌমা দিয়া চক্রবর্তী বিশ্বাস অন্য এক নজির গড়েছেন। আর এই সুবাদে শাশুড়ি-বৌমার চিরকালীন সম্পর্ককে এক অন্যমাত্রা দিয়ে বসেছেন।
বছর সাতান্নর ডলি বিশ্বাসের বছর দশেক আগে যকৃতের সমস্যা ধরা পড়ে। এই চিকিৎসা যথেষ্টই ব্যয়বহুল। কৃষি দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী অনুপকান্তি বিশ্বাস তবুও মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্য সমস্ত খরচ সামলে স্ত্রীর চিকিৎসা চালাচ্ছিলেন। দীর্ঘ এক দশক ধরে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরুর মতো জায়গায় চিকিৎসা চলে। তবে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় ‘লিভার সিরোসিস’ ধরা পড়ার পর থেকে ডলির শারীরিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসকরা সেই সময় তাঁকে যকৃৎ প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে ‘লিভার ডোনার’ মেলা সহজ নয়। মাকে বাঁচাতে ছেলে ঐকতান যকৃৎ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে চিকিৎসকরা ঐকতানের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে, দিনে দিনে ডলির শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। বছর দুয়েক আগে ঐকতানের বিয়ে হয়। বছর ত্রিশের দিয়া বৌমা হয়ে ডলির পরিবারে আসেন। রোজকে রোজ অসুস্থ হয়ে পড়া শাশুড়িকে দেখে দিয়া প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। তবে হাল ছাড়তে রাজি ছিলেন না। পুরোদমে তিনি শাশুড়ির সেবা শুরু করেন। কিন্তু কিছুতেই পরিস্থিতি আয়ত্তে আসছিল না। মাকে বাঁচাতে স্বামী একসময় যকৃৎ দিতে চেয়েছিলেন শুনে দিয়াও একই কাজে আগ্রহ দেখান। দুজনের রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় দিয়া একাজে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান।
রক্তের সম্পর্ক নেই এমন কেউ যকৃৎ দান করতে চাইলে আদালতে হলফনামা দিয়ে আবেদন করতে হয়। সেইমতো কলকাতার আলিপুর জেলা আদালতে হলফনামা দিয়ে আবেদন জানানো হয়। যকৃৎ দান করতে কেউ রক্তের সম্পর্ক নেই, এমন কেউ তাঁকে কোনও চাপ দিয়েছেন কি না বলে বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে দিয়ার আবেদনের শুনানি চলাকালীন বিচারক জানতে চান। শাশুড়ি তাঁর মায়ের মতো হওয়ায় দিয়া নিজেই একাজে নেমেছেন বলে জানানোয় বিচারক তাঁকে সম্মতি দেন। আদালতের সম্মতি মেলার পর ময়নাগুড়ির বিডিও শুভ্র নন্দীর হাত ধরে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক নথি কলকাতার স্বাস্থ্য ভবনে পৌঁছোয়। সেখান থেকে অপারেশনের ছাড়পত্র মেলে। দিন কয়েক আগে গুরুগ্রামের চিকিৎসক সঞ্জয় গজার নেতৃত্বে কলকাতার চিকিৎসক রাহুল রায়, ডাঃ পঙ্কজ সোনার সহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে নিয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠিত হয়। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শাশুড়ি ও বৌমার অস্ত্রোপচার হয়। এজন্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা খরচ হয়। ঐকতান বলেন, ‘আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে এত খরচ করে অস্ত্রোপচার সম্ভব হয়েছে।’ শাশুড়ি ও বৌমা আপাতত কলকাতাতেই আছেন। তাঁদের শারীরিক কোনও সমস্যা হবেনা বলে চিকিৎসকরা আশ্বাস দিয়েছেন। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো তাঁদের কয়েক মাস হোম আইসোলেশনে থাকতে হবে।
ময়নাগুড়ি সুভাষনগরপাড়ার প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্যা ডলি জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। কিন্তু প্রকৃত মানুষের মতো মানুষটি যে কোনওদিন তাঁরই পরিবারের একজন হয়ে আসতে পারে কোনওদিন কল্পনাও করেননি। শাশুড়ির চোখে জল, ‘ও আমার মেয়ের থেকেও বেশি।’ চোখে জল নিয়ে দিয়া বললেন, ‘শাশুড়ি প্রাণে বেঁচেছেন, এর থেকে বড় পাওয়া আর আমার কী থাকতে পারে!’ দিয়ার স্বামী পেশায় অধ্যাপক ঐকতান বললেন, ‘পরিবারের সবাই যে কতটা খুশি সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’ তাঁদের মেয়ে প্রায় অসাধ্য এক কাজ করে বসায় দিয়ার বাবা দিবাকর চক্রবর্তী ও মা দীপিকা চক্রবর্তী খুব খুশি। কে বলে শাশুড়ি-বৌমা সম্পর্কে সুখ নেই? ডলি-দিয়ার সম্পর্ক একে অন্যমাত্রা দিয়ে বসে আছে।