প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: টানা তিনদিনের বন্দিদশা কাটিয়ে, আবারও ছন্দে ফিরছে রাজধানী দিল্লি। রবিবার নয়াদিল্লির ‘ভারত মণ্ডপম’ সেন্টারে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা হয়েছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের। গতকাল থেকেই একে একে দিল্লি ছেড়ে দেশে ফেরার পথ ধরেছেন জো বাইডেন, শেখ হাসিনা-সহ একাধিক শীর্ষ রাষ্ট্রনেতারা। এখনও কিছু রাষ্ট্রনেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য নয়াদিল্লিতে থেকে গেলেও, তিনদিন ধরে সেই আঁটোসাটো ভাব অনেকটাই স্তিমিত। স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি শিথিল হতেই সোমবার আবারও পুরোনো ছন্দে দেখা গেল দিল্লিকে। রাস্তায় রাস্তায় যানজট, ট্রাফিক আর হট্টগোলে দিল্লি যেন ফিরে এল স্বমহিমায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সাধারণ মানুষ।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সোমবার দিল্লি সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে দিল্লিবাসীদের উদ্দেশে ধন্যবাদজ্ঞাপন করা হয়েছে। দিল্লি সরকারের অধীনস্থ দুই মন্ত্রী আতিশী এবং সৌরভ ভরদ্বাজ এদিন বিবৃতি জারি করে জি-২০ আবহে অসীম ধৈর্য এবং সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য দিল্লিবাসীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। দিল্লি নগরোন্নয়ন মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ এদিন সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেন, ‘দিল্লির ২ কোটি মানুষের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, জি-২০ সামিটের সাফল্যের জন্য তাঁদের কৃতিত্ব কম নয়, সর্বাগ্রে তাই দিল্লিবাসীদের অভিনন্দন জানাই। টানা তিনদিন নিজেদের ঘরবন্দী করে রাখেন দিল্লিবাসীরা। জরুরি কাজে বের হয়ে অনেক সময় তাঁদের নিরাপত্তাজনিত নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে৷ তবু তাঁরা অধৈর্য হননি, নিরাপত্তা কর্মীদের যথাসম্ভব সহযোগীতা করেছেন।’ এই তিনদিন দিল্লির একাংশ অবরুদ্ধ রাখা হয়। বহু দোকানপাট, বাজারহাট রাখা হয় বন্ধ৷ আমরা এই অসুবিধার কথা বুঝি৷ কিন্তু জি ২০ এর মতো আন্তর্জাতিকস্তরের সম্মেলনে বহু বিধিনিষেধ থাকে। সে সব মেনেই সাধারণত গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জি-২০ বৈঠকের এই সাফল্যে নি:সন্দেহে দিল্লিবাসীদের ভাগিদারী অনস্বীকার্য জানিয়েছেন সৌরভ ভরদ্বাজ।
দিল্লির পিডব্লুডি মন্ত্রী আতিশী জানান, ‘সাধারণ মানুষের করের টাকায় জি-২০’র সময় দিল্লিতে সৌন্দর্যায়ণ ঘটানো হয়৷ জি-২০ শেষ মানেই তার শেষ নয়। দিল্লির সৌন্দর্যায়ণ আগামী দিনেও জারি রাখার জন্য দিল্লি সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ অন্যদিকে ভারতের সভাপতিত্বে সদ্য সমাপ্ত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনকে একবিংশ শতাব্দীর সবথেকে সফল আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন হিসেবে চিহ্নিত করলেন কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি। তাঁর মতে, গোটা জি-২০ সভাপতিত্বের মেয়াদকালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর বার্তাকে তুলে ধরেছে মোদি সরকার। জন ভাগীদারির চেতনা বিস্তার করেছে। ‘নয়াদিল্লি ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ এরই ফল বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। নয়াদিল্লির জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনকে একবিংশ শতাব্দীর সবথেকে সফল বলার পিছনে বেশ কিছু কারণও উল্লেখ করেছেন তিনি। রেড্ডির মতে, আন্তর্জাতিক ফোরাম গুলিতে ‘গ্লোবাল সাউথ’ অর্থাৎ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কন্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্বের জন্য বারংবার দাবি জানিয়েছে ভারত। জি-২০-এর নতুন স্থায়ী সদস্য হিসেবে আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তি সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। এহেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঐক্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে নেতৃত্বদানের ক্ষমতার প্রমাণ ক্ষেত্রে দিয়েছে ভারত।
জি-২০র সমাপ্তিপর্বের পর নানা ভাবে শীর্ষ সম্মেলনের প্রশস্তিগীতি ছুঁড়ে দিতে যখন বিন্দু মাত্র কার্পণ্য করছেন না কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির সর্বোচ্চ প্রতিনিধিরা, তখনই টানা বর্ষণে সোমবারও অপরূদ্ধ হয়ে রইলো ভারত মণ্ডপম সেন্টার। এদিনও সেখানে ইতি-উতি দেখা গেছে জমা জল। এখনও সে জল পাম্প করে বের করার কাজ জারি রয়েছে৷ শনিবার সামান্য বৃষ্টিতেই এই সভাস্থল ভেসে যায়। জল জমে যায় ভারত মণ্ডপমের প্রবেশ দ্বারে। এ নিয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয় কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে। টুইটার হ্যান্ডেলে সেই জল থইথই ভারত মণ্ডপমের ভিডিও পোস্ট করেন যুব কংগ্রেসের প্রধান শ্রীনিবাস বি ভি। তিনি লেখেন, ‘উন্নয়ন সাঁতার কাটছে।’ টুইট করেন তৃণমূল সাংসদ জহর সরকারও। একইসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ তথা দলের মুখপাত্র সাকেত গোখলে লেখেন, ‘বৃষ্টির কারণে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সভাস্থল প্লাবিত। চার হাজার কোটি টাকা খরচ করার পর এই হল পরিকাঠামোর অবস্থা? জি-২০ তহবিলের এই চার হাজার কোটি টাকার কত টাকা আত্মসাৎ করেছে মোদী সরকার?’ অবশ্য সাকেতের এই দাবি নস্যাৎ করেছে কেন্দ্র সরকারের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। সাকেতের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তারা বলেছেন, এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক।
এদিকে সোমবার দিল্লি পুন:সক্রিয় হয়ে উঠলেও জি-২০ র আবহে নিরাপত্তাকালীন কিছু জরুরি পদক্ষেপ এখনই প্রত্যাহার করা হবে না বলেও জানিয়েছে নগরন্নোয়ন দফতর, যার মধ্যে বাঁদর দের খ্যাঁদাতে লাগানো হনু ফ্লেক্স এখনই খুলে ফেলবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না এনডিএমসি৷ দিল্লি নগরোন্নয়ন দপ্তর জানাচ্ছে, আস্তে আস্তে দিল্লি স্বাভাবিক হচ্ছে, অফিস কাচারি, বাজারহাট সব খুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে এখনই ওই ফ্লেক্সগুলি সরানো হবে না। দিল্লিবাসীর নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই পদক্ষেপ। এর পাশাপাশি সামান্য হলেও লুটিয়েন্স, পুরনো দিল্লি, প্রগতি ময়দান এবং চাণক্যপুরীর ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভের একটি বড় অংশে বহাল থাকবে নিরাপত্তা৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় সরকারের এক শীর্ষ আধিকারিক জানান, ‘জি২০ শুরু হওয়ার আগে মোদীজি দিল্লিবাসীদের কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নাগরিক গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হবে। সেই লক্ষ্যে কাজ করে দিল্লিকে যত দ্রুত সম্ভব পুরনো ছন্দে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকারপক্ষ। শুক্রবারের মধ্যে দিল্লি আবারও পুরনো ইমেজে ধরা দেবে।’ সেই স্থিতিশীলতার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই দিল্লির বুকে শুরু হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি৷