প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: দিন তিনেক আগে নিজের এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে দাবি করেন, কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে আনা ‘অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন’ করার অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় লোকপাল। এ ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিজ অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি সরে এলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে।
শনিবার সন্ধ্যায় সামাজিক মাধ্যমে জাতীয় লোকপালের তরফে একটি চিঠি তুলে ধরেন নিশিকান্ত। তাতে দেখা গিয়েছে, জাতীয় লোকপাল আদালতের ডেপুটি রেজিস্ট্রার অরবিন্দ মিশ্রা জানিয়েছেন, গত ২১ অক্টোবর নিশিকান্ত দুবের দায়ের করা ‘অভিযোগ’ গৃহীত ও নথিবদ্ধ করা হয়েছে। সহজ ভাষায়, নিশিকান্তের ইমেল বা পত্র মারফত দায়ের করা এক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথাগত প্রাপ্তিস্বীকার পত্র পাঠিয়েছে জাতীয় লোকপাল আদালত। চিঠিতে কোথাও অভিযোগ বা অভিযুক্তের বিষয়ে উল্লেখ করাও নেই। এরই সঙ্গে নিশিকান্ত দুবের ক্ষোভ বার্তা, ‘দেশের সাংবিধানিক সংস্থাগুলির উপর প্রহার করা টুকরে টুকরে গ্যাং (পড়ুন বিরোধী শিবির) গুলির ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সাংসদের (পড়ুন মহুয়া মৈত্র) বিরুদ্ধে লোকপাল আদালতে আমি অভিযোগ দায়ের করি এবং তার প্রেক্ষিতে লোকপাল তদন্তকারী সংস্থাকে কেস দাখিল করতে বলে।’ নিশিকান্তের দাবি, ‘আমি কোনও সাংবিধানিক সংস্থা বা এজেন্সির মুখপাত্র নই। আমি শুধুই এক অভিযোগকারী।’
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ এ জাতীয় স্বগতোক্তি বা আত্ম-ব্যাখার কারণ কী গোড্ডার বিজেপি সাংসদের? বৃহস্পতিবার এথিকস কমিটির বৈঠকে মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজ করার দাবি জানিয়েছে বিনোদ সোনকারের নেতৃত্বাধীন এথিকস প্যানেল। কিন্তু তার আগেই বুধবার মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দিল ‘লোকপাল’, এমনই দাবি করে শোরগোল ফেলেছিলেন ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। সেদিন নিজের ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে পোস্ট করে নিশিকান্ত দাবি করেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তাকে বন্ধক রেখে দুর্নীতি করার জন্য আমার দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে লোকপাল আদালত অভিযুক্ত সাংসদ মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।’
নিশিকান্তের এই বার্তা প্রকাশ্যে আসা মাত্র আলোড়ন পড়ে দিল্লিতে। ওদিকে চুপ করে বসে থাকেননি মহুয়া মৈত্রও। পালটা সরব হয়ে বলেন, ‘সিবিআই-এর কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই? আগে আদানিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করুক তারা। পরে যদি আমার জুতোর সংখ্যা গুনতে চায়, স্বাগত।’
মহুয়ার দুর্নীতির ফয়সালা করতে লোকপাল আদালত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে, নিশিকান্ত দুবে এমন দাবি করলেও তা সরাসরি মানতে চাননি অনেকেই। এথিকস কমিটির সদস্য এবং বিহারের জেডিইউ সাংসদ গিরিধারী যাদব প্রশ্ন তোলেন, ‘লোকপাল আদালত মহুয়ার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, তার অর্ডার কপি কোথায়? কেন নিশিকান্ত অর্ডারের কপি শেয়ার করছেন না? এটা আসলে মানসিক ভাবে নিপীড়নের নয়া পদ্ধতি।’
বাম সাংসদ পি আর নটরাজন বলেন, ‘লোকপাল আদালতের লিখিত নির্দেশনামা স্বচক্ষে না দেখা পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’ নটরাজন এও বলেন, ‘সিবিআই তদন্ত করতেই পারে, সে ক্ষেত্রে এথিকস কমিটির ভূমিকা কী হবে? আদৌ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কী লোকপাল, সেটাই এখনও পরিষ্কার নয়। আগে নির্দেশনামা সামনে আসুক, তারপর এ নিয়ে ভাবব।’
বলে রাখা জরুরি, নিশিকান্ত দুবের এই অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়, পাঠানো হয় মেসেজও, চাওয়া হয় লোকপালের আদেশনামা। কিন্তু নিশিকান্ত দুবে এর কোনও জবাব দেননি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এ প্রসঙ্গে জাতীয় লোকপালের তরফেও কোনও মন্তব্য, মুচলেকা বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে, এথিকস কমিটি মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজ করার দাবি জানালেও, এখনও পর্যন্ত লোকপাল বা সিবিআই তদন্তের কোনও গতিবিধি চোখে পড়েনি। ফলে প্রকারন্তরে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবির অভিযোগ ওঠে নিশিকান্তের বিরুদ্ধে, যার প্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে এই স্বীকারোক্তির ফোয়ারা ছোটালেন নিশিকান্ত।
অন্যদিকে, এথিকস কমিটির বৈঠকে ভোটাভুটির সূত্র ধরে দল থেকে বহিষ্কৃত কংগ্রেস সাংসদ প্রীনিত কউরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে। এথিকস কমিটির বৈঠকে ভোটাভুটি হলে পার্টিলাইন অমান্য করে মহুয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেন প্রীনিত। ৬-৪ ভোটে হেরে যান মহুয়া। ফেব্রুয়ারিতে দলবিরোধী কাজের জন্য বহিষ্কৃত হলেও, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং-র স্ত্রী প্রীনিত এখনও খাতায়-কলমে কংগ্রেসের সাংসদ। কিন্তু বৃহস্পতিবারের বৈঠকে তিনিই হয়ে উঠলেন ‘গেম চেঞ্জার’। তাঁর ভোট মহুয়ার পক্ষে এলে, পুরো খেলাই ঘুরে যেতে পারত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আদতে তা হয়নি, ফলে প্রীনিত স্বাভাবিকভাবেই দলের অভ্যন্তরে ‘গদ্দার’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। দলীয় সাংসদ রভনীত সিং বিট্টু বলেন, ‘উনি (প্রীনিত কউর) ঘরশত্রু বিভীষণ। অবিলম্বে তাঁর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা পদক্ষেপ নিক দল।’ এই বিষয়ে প্রীনিতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও, তিনি ফোন ধরেননি।