প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্যি। ৭৫ বছরের সংসদীয় ইতিহাসে কার্যত বিরল এবং অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার সাক্ষী রইল লোকসভা। সোমবার সংসদের পুরোনো ভবনে আয়োজিত শেষ অধিবেশনে গমগম করে বেজে উঠল জাতীয় সংগীত। একবার নয় দু-দুবার। ঘটনাটি কেন্দ্র করে চরম অস্বস্তির মুখে সরকার পক্ষ। কিন্তু কী করে এমনটি হল?
সোমবার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিট নাগাদ সংসদের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে লোকসভায় হাজির হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী সভাকক্ষে পা রাখা মাত্র ‘মোদি মোদি’ জয়ধ্বনি তোলেন শাসক দলীয় প্রতিনিধিরা। হাজির হন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নীতিন গড়করি সহ বিজেপির সংসদীয় দলের তামাম প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে, বিরোধী শিবিরে উপস্থিত কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেত্রী সনিয়া গান্ধি, অধীর রঞ্জন চৌধুরী, ন্যাশনাল কনফারেন্স সুপ্রিমো ফারুক আবদুল্লা, ডিএমকে নেতা টি আর বালু এবং তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারা।
মোদি আসন গ্রহণ করা মাত্র আচমকা বেজে ওঠে জাতীয় সংগীত। সাংবিধানিক প্রথা মেনে সকলে উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ‘জনগণমণ’তে গলা মেলান। তখনই দেখা যায়, খোদ লোকসভা অধ্যক্ষ ওম বিড়লার আসন খালি, তিনি তখনও হাজির হননি। স্পিকারকে ছাড়াই বেজে উঠেছে জাতীয় সংগীত, যা মূলত অসাংবিধানিক, সংসদীয় রীতি বিরুদ্ধ। সেই মুহূর্তে সংসদ টিভির ক্যামেরায় দেখা যায়, স্পিকারের আসনের ঠিক পিছনেই ভ্রুকুটি শানিয়ে দাঁড়িয়ে ওম বিড়লা। এই ঘটনায় তিনিও বেজায় অপ্রস্তুত। এরপর ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ঠিক ১১টা নাগাদ স্পিকার তাঁর আসন গ্রহণ করা মাত্র আবারও বেজে ওঠে জাতীয় সংগীত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহ সমস্ত সাংসদরা আবারও নিজ স্থানে উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। কিন্তু ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্য, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখেচোখে ধরা পড়ে অস্বস্তি। অনেকের মুখে দেখা যায় উপহাসের হাসি।
এরপরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সদস্যরা। বিএসপির দানিশ আলি উঠে দাঁড়িয়ে সরাসরি আক্রমণ শানান স্পিকারের উদ্দেশ্যে, তর্জনি নিক্ষেপ করে বলেন, ‘এসব কী হচ্ছে? দু-দুবার জাতীয় সংগীত বাজানোর কারণ কী? এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?’ কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী, গৌরব গগৈরা বলেন, ‘এভাবে দু-দফা জাতীয় সংগীত বেজে ওঠার ঘটনা কার্যত বিরল ও অবমাননাকর। কার জন্য বাজানো হল? কেন স্পিকারের জন্য অপেক্ষা না করেই বেজে উঠল জাতীয় সংগীত? তবে কী এটা অন্য কারুর জন্য (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি) বিশেষ খাতিরদারি? খোদ লোকসভা অধ্যক্ষের প্রতি এই অবমাননা।’ সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়ায় লোকসভায়। যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খান বিড়লা।
লোকসভা অধ্যক্ষ ওম বিড়লা বলেন, ‘এই ঘটনা অনভিপ্রেত। একটা টেকনিকেল এরর হয়েছে। আমি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছি।’ তিনি এও জানান, সভাকক্ষে জাতীয় সংগীত বাজানোর নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই। অবশ্যই এই কাণ্ড নিয়ে খোঁজখবর নেবেন তিনি। প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘এই ঘটনা সংসদীয় ইতিহাসে কার্যত নজিরবিহীন। এত বছর সংসদে আছি, কখনও এমনটি ঘটতে দেখিনি। তবে এই সরকারের জমানায় সবই সম্ভব।’ বিএসপির সাংসদ দানিশ আলি বলেন, ‘স্পিকার আসনে নেই, অথচ কিনা বেজে উঠল জাতীয় সংগীত। সেটা কী সংসদীয় নীতি নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন?’ বলাবাহুল্য এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনও লোকসভা সচিবালয় সূত্রে।