প্রসেনজিৎ সাহা, দিনহাটা: ফেব্রুয়ারি মাসে দিনহাটা (Dinhata) মহকুমা হাসপাতালের প্রকাশিত একটি রিপোর্ট জেলাজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। সম্প্রতি নাবালিকাদের সন্তানপ্রসবের বিষয়টি নজরে এসেছিল চিকিৎসকদের। তাই সেই সংক্রান্ত তথ্য নথিভুক্ত করতে শুরু করেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাতে দেখা যায়, শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসেই মহকুমা হাসপাতালে ২২৪ জন নাবালিকা সন্তানপ্রসব করেছে। তারপরই নাবালিকাদের বিয়ে রুখতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলেন প্রশাসনের কর্তারা। তবে দিনহাটা থানার (Dinhata Police) একটি রিপোর্ট বলছে, এতসবের পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি।
সম্প্রতি থানা থেকে যে রিপোর্ট জেলায় পাঠানো হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে দিনহাটা থানায় ১৪২টি নিখোঁজ সংক্রান্ত অভিযোগ (Girl Missing) হয়েছে। তারমধ্যে তিরিশজন নাবালিকা ও তিনজন নাবালক নিখোঁজের অভিযোগ আছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে ছয়জনেরও বেশি নাবালিকা নিখোঁজ হচ্ছে। দু’একটি বাদে সবক্ষেত্রেই পুলিশি তদন্তের পর দেখা যাচ্ছে, প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছে নাবালিকা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির অমতে বিয়েও করে ফেলছে তারা। এই পরিসংখ্যান থেকেই রেকর্ড সংখ্যক নাবালিকার মা হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট বলেই মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। আর এই প্রবণতা রুখতে না পারলে ফল যে মারাত্মক হবে সেবিষয়েও সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা।
পুলিশের রিপোর্ট সামনে আসতেই নতুন করে শোরগোল পড়েছে দিনহাটায়। তবে পুলিশকর্তাদের একাংশের কথা, বহু ঘটনার অভিযোগ তাঁদের কাছে পৌঁছায় না। স্থানীয় স্তরেই মীমাংসা করে নেওয়া হয়। সব অভিযোগ থানায় পৌঁছোলে নিখোঁজ নাবালিকার সংখ্যা যে কয়েকগুণ বেশি হত সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁরা। দিনহাটা থানা যদিও ১৪২টি কেসের মধ্যে ৪৮টি ক্ষেত্রে নিখোঁজদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। দিনহাটা থানার এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত হওয়ার পর পালিয়ে গিয়ে নাবালিকাদের বিয়ে করার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। আমরা উদ্বিগ্ন।’ ভৌগোলিক দিক থেকে দিনহাটা সীমান্তবর্তী মহকুমা। এরফলে কমবয়সি মেয়েদের অনেকক্ষেত্রেই ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে পাচারের ঘটনাও ঘটছে। তা নিয়েও উদ্বেগ বেড়েছে প্রশাসনের।
দিনহাটার মহকুমা শাসক বিধুশেখরের কথা, ‘আমরা থানার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। ভোট মিটলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।’ আইনজীবী কল্লোল রায় সিংহের বক্তব্য, ‘নাবালিকাদের বিয়ে, নিখোঁজ সংক্রান্ত মামলা ক্রমেই বাড়ছে। আমরা একাধিক স্কুলে ইতিমধ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়েছি। এই কাজে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
নাবালিকাদের বিয়ে রুখতে স্কুল স্তর থেকেই পড়ুয়া ও অভিভাবকদের মধ্যে আরও সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলেই মনে করছেন পুলিশকর্তারা। কোচবিহার এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিরঞ্জীব রায়ের ব্যাখ্যা, ‘মাধ্যমিকের পর ছেলেমেয়েদের বয়স দাঁড়ায় ১৫-১৬ বছর। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধির সময়কাল। আর এসময়টাই ছেলেমেয়ে উভয়ের শরীর ও মন চঞ্চল থাকে। এবং উভয়ের শারীরিক দিক থেকে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। এরফলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। সেখান থেকেই পালানোর রাস্তা বেছে নেয়। এরপর যতক্ষণে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, ততক্ষণে সমাজ তাদের প্রত্যাখ্যান করে। তাই অভিভাবক থেকে শিক্ষক কিংবা খেলাধুলোর কোচ সকলকে এই বয়সি ছেলেমেয়েদের বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করতে হবে।’