সৌভিক সেন ও অনিমেষ দত্ত
শিলিগুড়ি: তিনি ডাক্তার। রোজ রুগী দেখেন। সেই ফাঁকে আবার তরুণ প্রজন্মকে অনলাইনে পড়ানও।
এমনটা আবার হয় নাকি? আজ্ঞে হ্যাঁ। শিক্ষকতা তাঁর কাছে প্যাশন। তিনি অর্কদীপ বিশ্বাস। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ডক্টর লুজার’ নামে জনপ্রিয়। ডাক্তারি পাশ করেও টিউশন পড়াচ্ছিলেন বলে তাঁকে সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। তবে তিনি সেই সমালোচনা গায়ে না মেখে নিজের প্যাশন ফলো করেন। নিজের নাম দেন ‘ডক্টর লুজার’।
কলকাতার রাজারহাটের বাসিন্দা। বর্তমানে দুর্গাপুর মেডিকেল কলেজে কর্মরত। বাংলায় ফিজিক্সওয়ালাদের খোঁজ করতে গিয়ে অর্কদীপের ‘অক্সিজোম’ নামক ডিজিটাল কোচিংয়ের প্ল্যাটফর্মের সন্ধান পাওয়া গেল। যিনি পড়ুয়াদের জয়ের পথ দেখাচ্ছেন।
নিট কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে ফিজিক্সওয়ালা অলখ পান্ডের লড়াই সম্পর্কে এখন সকলেই ওয়াকিবহাল। সেই লড়াইতে বাংলা থেকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখা গিয়েছে অর্কদীপকে। তিনিও সম্প্রতি দিল্লিতে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র অর্কদীপের বরাবর ইচ্ছে ছিল বাংলা ভাষায় পড়ানোর। সেই যাত্রা শুরু ২০২১ সালে। ফোনে ধরা হলে তাঁর মন্তব্য, ‘আমি আগে বিভিন্ন অফলাইন কোচিং ইনস্টিটিউটে ইংরেজি এবং হিন্দিতে পড়াতাম। হঠাৎ মনে হল, বাংলা ভাষাতেও তো পড়ানো সম্ভব।’ যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। শুরু হয়ে গেল বাংলায় পড়ানোর অধ্যায়।
অর্কদীপের মতো উত্তরবঙ্গে এই ধরনের উদ্যোগ কেউ নিয়েছেন? কথা হচ্ছিল শিলিগুড়ির বাসিন্দা, পশ্চিমবঙ্গ গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতির কর্তা বিবেকানন্দ সাহার সঙ্গে। হায়দরপাড়ার শ্রীমা সরণির বিবেকানন্দের প্রাইভেট টিউশন করেই জীবন চলে। তাঁর স্ত্রী ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার পিঙ্কি সাহা। বিবেকানন্দের কথা, ‘ডিজিটাল মাধ্যমে পড়াশোনার গুরুত্ব সময়ের দাবি মেনেই। আমাদের সংগঠনের প্রায় ১৫-১৬ জন শিক্ষক উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার পড়ুয়াদের ভার্চুয়ালি পড়াচ্ছেন। তবে সেই ক্লাসগুলি আপাতত স্কুল ও কলেজ স্তরেই সীমাবদ্ধ।’ তিনি নিজেও গুগল মিটে বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়, পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন পড়ুয়াকে পড়ান।
শিলিগুড়ির কমার্সের শিক্ষক হিল্লোল দাস ও সুরজ পোদ্দার, কলা বিভাগের জয়দীপ চক্রবর্তী, বিজ্ঞানের শুভরঞ্জন সাহাও বিবেকানন্দের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পড়াচ্ছেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের আবার নিজস্ব অ্যাপ রয়েছে। ইংরেজি শিক্ষক দুর্লভ সরকার গ্রামার এবং স্পোকেন ইংলিশ সংক্রান্ত ভিডিও নিয়মিত ইউটিইউবে আপলোড করেন।
দীপঙ্কর পোদ্দার একটি ইউটিউব চ্যানেলে স্কুল স্তরে অঙ্ক শেখান। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই? দীপঙ্করের ব্যাখ্যা, ‘আছে। কলেজের এক অধ্যাপকের সঙ্গে একটা প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। দুজনে মিলে ইউটিউবে একটা চ্যানেল খোলার ইচ্ছে আছে। সেখানে মূলত রাজ্য এবং সর্বভারতীয় জয়েন্ট পরীক্ষা সংক্রান্ত ভিডিও আপলোড করব।’ তবে অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে মিলে কিছু করার ভাবনা আপাতত তাঁর নেই।
গৌড়বঙ্গে অবশ্য ভার্চুয়াল টিউশন প্রায় হয় না। কথা হল বালুরঘাটের মাধব সাহা ও ইসলামপুরের সুব্রত দত্তের সঙ্গে। এঁরা দুজনেই ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাইভেট টিউটর অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। দুজনেই মনে করছেন, অনলাইনের চেয়ে অফলাইনে পড়ানো বেশি উপযোগী। একই ঢংয়ে শোনালেন, ‘অফলাইনে পড়ুয়ারা সশরীরে উপস্থিত থেকে শিক্ষকের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারে। অনলাইনে যা হয় না।’
যাঁকে দিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল, সেই অর্কদীপের ভার্চুয়াল ক্লাসে অবশ্য উত্তরবঙ্গের বহু পড়ুয়া থাকে। এমনকি অসম, ত্রিপুরাতেও ‘ডক্টর লুজারের’ ছাত্র অনেক। অর্কদীপের লক্ষ ছিল বাংলার ছেলেমেয়েদের স্বল্প খরচে নিটের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
তাঁর অভিজ্ঞতা, বাংলার প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের ডাক্তারি পড়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় ভাষা। বলছেন, ‘নিটের সিলেবাস সিবিএসই ঘেঁষা। ফলে বাংলার প্রান্তিক পড়ুয়ারা এমনিতেই পিছিয়ে থেকে শুরু করে। বর্তমানে বাংলা ভাষায় প্রশ্নপত্র থাকলেও, সেখানে অনেক ভুল থাকে। সেইদিক থেকে বাংলার শিক্ষার্থীদের লড়াইটা অনেক বেশি।’ তারপরেও তাঁর ডিজিটাল ক্লাসে পড়ে মুর্শিদাবাদের অপূর্ব ৬৯৫ স্কোর করেছেন এবার। এমনকি ২০২২ সালে মাধ্যমিকে প্রথম পূর্ব বর্ধমানের রৌনক মণ্ডল অক্সিজোমে পড়েছেন, তাঁর স্কোর ৬৮০।
নিট কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রণী অর্কদীপ এবং অলখকে কুর্নিশ জানিয়েছেন দমদমের অয়ন চক্রবর্তী। করোনাকালে ডিজিটাল মাধ্যমে টিউশনে পথ চলা শুরু। প্রথমে থার্ড পার্টি অ্যাপ ব্যবহার করতেন। ২০২২ সাল থেকে নিজস্ব অ্যাপেই ক্লাস নিচ্ছেন। অয়ন এবং তাঁর সহকর্মীরা মূলত আইআইটি জ্যাম, সিইউইটি এবং স্নাতক স্তরে অঙ্ক শেখান। বাংলার বহু জেলার ছেলেমেয়েরা অয়নদের ছাত্র।
অয়নদের বরাবর চেষ্টা ছিল অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অফলাইনের পরিবেশ তৈরি করা। মোবাইলে ধরা হলে তাঁর মন্তব্য, ‘অনলাইনে এমসিকিউয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া সহজ। তবে এখানে লিখিত পরীক্ষায় নজর রাখা মুশকিল। নকল করার সুযোগ থাকে। আমরা জুম কলের সাহায্যে লিখিত পরীক্ষা চলাকালীন প্রত্যেক পড়ুয়ার ওপর কড়া নজর রাখি।’
ফোনেই কথা হল রাজারহাটের কৌশিক গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ডব্লিউবিসিএসের কোচিং দিচ্ছেন। প্রথমে এই মাধ্যমে পড়াতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় তাঁকে। ফোনে স্বীকারোক্তি, ‘২০১৮ সালে যখন শুরু করি, তখন এটা বোঝাতে গিয়েই হিমসিম খেয়েছি যে অনলাইনেও পড়াশোনা সম্ভব। এখন অবশ্য ছবিটা অনেক বদলেছে।’
অর্কদীপ, অয়ন, কৌশিকরা চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে বাংলায় এধরনের ডিজিটাল কোচিংয়ের উদ্যোগ এখনও খুব বেশি চোখে পড়ছে না। যদিও অনেকে প্রাইভেট টিউশনি করেন। কিন্তু তাঁরা এখনই ডিজিটাল ক্লাসের দিকে ঝুঁকতে রাজি নন।
একটা জিনিস স্পষ্ট। এই ব্যাপারে বাংলায় নানা মুনির নানা মত। হয়তো অদূরভবিষ্যতে সময়ের দাবি মেনে অনেকেই ডিজিটাল কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকবেন। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ডিজিটাল লার্নিয়ের সবটাই কি ঝাঁ চকচকে? কোনও কিছুই হয় সাদা বা কালো নয়। সবকিছুর একটা ধূসর দিক থাকে। উত্তরবঙ্গের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললে অনেক আঁধারও উঠে আসছে।