উত্তরবঙ্গ ব্যুরো : বাড়িতে নগদ টাকা নেই বলে চাঁদা আদায়কারীদের পরে আসতে বলার বহু পুরোনো কায়দা এখন ব্যাকডেটেড। ওঁরা এখন দারুণ স্মার্ট। চাঁদা দিতে এতটুকু বেগরবাই করলেই ওঁরা সামনে বাড়িয়ে দিচ্ছেন প্লাস্টিক বা নিদেনপক্ষে কাগজে ছাপানো কিউআর কোড। তা না থাকলেও কুছ পরোয়া নেই। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে তার স্ক্রিনেই সটান কিউআর কোড দর্শন। দেখে বছরভর জিপে, ফোনপে, পেটিএমের মতো ইউপিআই অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অনেকেরই মুখে হাসিটা ম্লান। হাতির কাদায় পড়ার দশা। অগত্যা পকেট থেকে নিজের মোবাইল বের করে সেই কিউআর কোড স্ক্যান করে নির্দিষ্ট ঠিকানায় টাকা পাঠিয়ে দেওয়া। দেখে চাঁদা আদায়কারীদের মুখে ইয়া বড় হাসি। উত্তরবঙ্গ স্মার্ট চাঁদায় মজেছে।
গাড়ির যন্ত্রাংশ লেবেল করতে জাপানি সংস্থা ডেনসো ওয়েভ ১৯৯৪ সালে কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড আবিষ্কার করেছিল। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার জনপ্রিয় হয়ে ওঠা। ট্রেনের টিকিট কাটা থেকে শুরু করে পাড়ার ফুচকার দোকান, আজকাল সর্বত্রই তার অবাধ গতিবিধি। আলিপুরদুয়ারে ফালাকাটার মাদারি রোড দুর্গোত্সব কমিটির সম্পাদক দীপঙ্কর সাহার মুখে হাসি, ‘আমাদের এলাকায় বহু চাকরিজীবী। বাড়িতে গেলে অনেককেই পাওয়া যায় না। চাঁদা আদায় করতে আমরা হয় তাঁদের বাড়িতে রসিদ রেখে আসছি অথবা হোয়াটসঅ্যাপে কিউআর কোড পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ কিউআর কোডের দৌলতে ভালোমতোই চাঁদা আদায় হয়ে যাচ্ছে বলে অরবিন্দপাড়া দুর্গোত্সব কমিটির তুহিন পাল জানালেন। যাঁরা চাঁদা দিচ্ছেন, তাঁরাও খুশি। অয়ন পাল বললেন, ‘এভাবে চাঁদা দেওয়ার অনেক সুবিধা। নগদ টাকা দেওয়ার ঝক্কি নেই। আবার টাকা সরাসরি পুজো কমিটির অ্যাকাউন্টেও চলে যাচ্ছে। মাঝখানে কোনও তছরুপির কোনও সম্ভাবনাই নেই।’
তাই বলে কি চাঁদা তোলার সাবেকি প্রথায় ইতি? মহাকালপাড়া দুর্গোৎসব কমিটির কোষাধ্যক্ষ মনোতোষ চৌধুরী বললেন, ‘আমি কিন্তু এভাবে চাঁদা তোলা সমর্থন করছি না। চাঁদা তোলা তো আর শুধু চাঁদা তোলা নয়, একরকম আত্মীয়তাও বটে। তাতে এভাবে ইতি টানার চেষ্টা হলে মন খারাপ হয় বৈকি!’ কোচবিহার বেলতলা ইউনিটের ক্লাব সম্পাদক হীরককুমার দাসেরও সম সুর, ‘আমাদের এলাকায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের সংখ্যাটা বেশি। কিউআর কোডের বিষয়ে অনেকেই সেভাবে সড়োগড়ো নন। তাই আমরা কিউআর কোডের পাশাপাশি রসিদেও টাকা নিচ্ছি।’ ভারত ক্লাব ও ব্যায়ামাগারের পুজো কমিটির সহ সম্পাদক কিংশুকরঞ্জন রাহারও একই বক্তব্য। কোচবিহার নিউটাউন ইউনিটের ক্লাব সম্পাদক অভিষেক সিংহ রায় অবশ্য কিউআর কোড নয়, সাবেকি চাঁদা আদায় ব্যবস্থাতেই ভরসা রাখছেন। স্মার্ট চাঁদায় অবশ্য দারুণ ভরসা মাথাভাঙ্গা আজাদ হিন্দ সংঘ দুর্গাপুজো কমিটির। গত বছর থেকেই কমিটি এভাবে চাঁদা তোলা শুরু করেছিল। এবারে তাতে দারুণ সাড়া মিলেছে বলে কমিটির সম্পাদক ভাস্কর বিশ্বাস জানিয়েছেন। স্মার্ট চাঁদা তাঁদের অনেক ঝক্কি মিটিয়েছে বলে সুভাষপল্লি ইউনিটের শম্ভু সাহার দাবি। সবাই এই পদ্ধতিতেই টাকা দিতে চাওয়ায় তাঁরা স্মার্ট চাঁদা নিচ্ছেন বলে দিনহাটার বোর্ডিংপাড়া সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ গৌতম চক্রবর্তী, গোসানি রোড সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ দীপঙ্কর ঘোষ জানিয়েছেন।
জলপাইগুড়ির বিগ বাজেটের পুজোগুলির অন্যতম কদমতলা দুর্গাবাড়ি পুজো কমিটি, পান্ডাপাড়া সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটিও এবারে হইহই করে স্মার্ট চাঁদায় মেতেছে। কদমতলা দুর্গাবাড়ি পুজো কমিটি তো এক ধাপ এগিয়ে রসিদের মধ্যেই কিউআর কোড ছাপিয়েছে। এতে দারুণ সাড়া মিলছে বলে কমিটির সম্পাদক কৌস্তভ বসু জানান। পান্ডাপাড়া সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির সহ সম্পাদক পার্থ বাড়ুইয়েরও একই দাবি। ময়নাগুড়িও পিছিয়ে নেই। ইউথ ক্লাব পুজো কমিটির যুগ্ম সম্পাদক বিশু সেন বললেন, ‘অনেকেই কিউআর কোডে পুজোর চাঁদা দিচ্ছেন।’ পশ্চিমপাড়া দুর্গাবাড়ি পুজো কমিটির যুগ্ম কোষাধ্যক্ষ পিয়াস সাহা, দীপম গুহ বা সানরাইজ ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদকদের অন্যতম প্রদীপ বণিকেরও একই দাবি। ধূপগুড়ির বটতলা ভক্ত সংঘ এবং মিলন সংঘের সমর্থনও কিউআর কোডের দিকেই। বটতলা ভক্ত সংঘের সৈকত সেনের বক্তব্য, ‘সময়ের সঙ্গে চলতে গেলে আধুনিক ব্যবস্থাকে আপন করে নিতেই হবে।’
শিলিগুড়ির অবশ্য সেভাবে স্মার্ট চাঁদায় এখনও সেভাবে ভরসা নেই। কেউ ক্যাশলেস পদ্ধতিতে চাঁদা দিতে চাইলে তাঁরা যাতে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারেন সেজন্য স্বস্তিকা যুবক সংঘ অবশ্য ব্যবস্থা করেছে।
তথ্য সহায়তা : ভাস্কর শর্মা, দেবদর্শন চন্দ, বিশ্বজিত্ সাহা, প্রসেনজিত্ সাহা, অনীক চৌধুরী, অভিরূপ দে, সপ্তর্ষি সরকার ও ভাস্কর বাগচী।