উত্তর সম্পাদকীয়

নতুন মার্চেন্ট অফ ভেনিসের প্রতীক্ষায়

  • অতনু বিশ্বাস

২০০৭ সালের ইতালি সফরের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়েছি মিলান শহরে। মাঝে একদিন ট্রেনে করে ঘুরে এসেছি ভেনিসেও। যাকে বলে ডে-ট্রিপ। ভেনিসের উপর একটা কোমল, মায়াবী আকর্ষণ ছিল ছেলেবেলা থেকেই। আসলে ভেনিসই বোধকরি প্রথম বিদেশি শহর যার কথা জেনেছিলাম যত্ন করে, খুব ছেলেবেলায় ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’-এর একটা দুর্বল বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে।

ভেনিস হল ‘সিটি অফ ক্যানালস’। শহরটার মাঝখান দিয়ে শিরা-উপশিরার মতোই গিয়েছে ক্যানালগুলো। আমস্টারডামের সঙ্গে ভীষণ মিল। গ্র্যান্ড ক্যানালটা খানিকটা ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো। ট্যুরিস্টের বিনোদন আর পয়সা খসানোর জন্য ক্যানালে রয়েছে ট্র্যাডিশনাল রোয়িং বোট ‘গন্ডোলা’। মনে পড়তে পারে মার্ক টোয়েনের ‘দি ইনোসেন্টস অ্যাব্রড’ বইটির কথা, যেখানে রয়েছে গন্ডোলা আর গন্ডোলা-চালকদের জীবনযাত্রার চমৎকার বর্ণনা। রিয়ালটো ব্রিজ আর সেন্ট মার্কস স্কোয়ারে যেন ট্যুরিস্টের ঢল নেমেছে। শহরের সর্বত্রই অবশ্য থিকথিক করছে অসংখ্য ট্যুরিস্ট। মানুষ এসেছেন ‘অ্যাড্রিয়াটিকের রানি’কে দেখতে।

পরদিন রাতে মিলানে আমার এক ইতালীয় অধ্যাপক বন্ধুর বাড়ির ডিনার টেবিলে গল্প হচ্ছিল ভেনিস নিয়ে। ঘটনাচক্রে ভেনিস আমার বন্ধুটির এবং ওর স্ত্রীর অসম্ভব পছন্দের জায়গা। হানিমুনে ওরা গিয়েছিল ভেনিসেই। দেখলাম, ভেনিস সম্পর্কে আমার বন্ধুটির রয়েছে এক গভীর সমবেদনা। ভেনিস যেন এক বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি। অতীতের মহা-সাম্রাজ্য আজ টিকে রয়েছে ট্যুরিস্টের দাক্ষিণ্যে। তাঁদের আপ্যায়ন করে, হোটেলে রেখে, খাইয়ে, স্যুভেনির বেচে, গন্ডোলায় চড়িয়ে। বলতে বলতেই আমার বন্ধুটি ভেনিসের অবক্ষয়ের পরিণতি নিয়ে এক বিষণ্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলে। বলে, ভবিষ্যতে কোনও সময়, হয়তো বিশ-পঞ্চাশ বছর পরে, ভেনিস হয়ে উঠবে আর এক ডিজনিল্যান্ড। ট্যুরিস্ট সেখানে ডিজনিল্যান্ডের মতোই টিকিট কেটে ঢুকবেন, মজা করবেন।

ভূমিকাটা একটু বড় হয়ে গেল। কিন্তু সেটার বোধহয় প্রয়োজন ছিল। ঘটনাচক্রে আমার সেই মিলানের বন্ধুটির ভবিষ্যদ্বাণী অংশত সফল হয়েছে আজ, ১৭ বছর পরে। ২৫ এপ্রিল থেকে চালু হয়েছে ‘ভেনিস অ্যাক্সেস ফি’। ভ্রমণকারীদের জন্য। প্রধানত শনি-রবি আর ছুটির দিন, সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত ভেনিসে যেসব ‘ডে-ট্রিপার’ আসবেন, অর্থাৎ যাঁরা সেদিন এসে সেদিনই ফিরবেন, তাঁদের দিতে হবে পাঁচ ইউরো প্রবেশমূল্য। যাঁরা ভেনিসে রাত্রিবাস করবেন, তাঁদের অবশ্য এই প্রবেশমূল্য মকুব। কিন্তু তাদেরও দেখাতে হবে হোটেল বুকিংয়ের প্রমাণপত্র। আসলে এসব ট্যুরিস্ট-নন্দিত স্থানে বহু স্থানীয় মানুষ তাঁদের বাড়িঘরকে হোটেলের ঘর হিসেবে বেআইনিভাবে ভাড়া দেন। চলে প্রভূত বেআইনি হোটেল ব্যবসা। ভেনিসের রাত্রিবাসকারী ভ্রমণকারীদের হোটেলের বুকিং দেখিয়ে শহরে ঢুকতে হবে বলে এইসব বেআইনি ব্যবসাতেও রাশ পড়বে বলে আশা করছেন আধিকারিকরা।

যাই হোক, ভেনিসের এই প্রবেশমূল্য নির্ধারণের নিয়মে যে সবাই খুশি, একথা মনে করার কোনও কারণ নেই। ভেনিস একদিন ডিজনিল্যান্ডে পরিণত হবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় আমার ইতালীয় বন্ধুর কণ্ঠে যে বিষাদের স্বর শুনেছিলাম তা যে এক বিচ্ছিন্ন সুরের অনুরণন তা তো নয়। আসলে কোনও এক ‘থিম পার্ক’ বা মিউজিয়ামের বাসিন্দা আমি, এই ভাবনাটা যে কোনও শহরের বাসিন্দাদের পক্ষে খুব সুখকর অনুভূতি নাও হতে পারে। শহরের বাসিন্দাদের বিভিন্ন সংগঠন তাই প্রতিবাদ করছে। ভেনিসকে ‘থিম পার্ক’ করে তোলার বিরুদ্ধে। এই টিকিটের ব্যবস্থাকে কেউ বলেছেন ‘পরিহাস’, কেউ বা বলেছেন রাজনৈতিক চাল। আসলে যাঁরা খরচ এবং কষ্ট করে ভেনিস পর্যন্ত আসবেন ভেবেছেন তাঁরা মাত্র পাঁচ ইউরোর জন্য পিছু হটবেন, এমন কথা ভাবা কঠিন বৈকি। প্রবেশমূল্যটা পাঁচের বদলে পঞ্চাশ ইউরো হলে কিছু প্রভাব পড়তে পারত বলে মনে করছেন কেউ কেউ। যেমন- প্রথম দিন, অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল, বিক্রি হয়েছে ৫,৫০০টি টিকিট, যার ফলে এসেছে ২৭,৫০০ ইউরো। এই টাকায় এই টিকিটের সিস্টেমটা চালানোর খরচ উঠতে পারে টেনেটুনে, তার বেশি কিছু নয়।

ভেনিসের মেয়র অবশ্য দাবি করেছেন যে বিশ্বে প্রথম এ ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে ভেনিসে, যেটা সম্ভবত ঠিকই। মেয়র মশাই দাবি করেছেন, এর ফলে কমবে উপচে পড়া ভিড়। ভ্রমণকারীরা উৎসাহিত হবেন বেশি সময় থাকতে, শুধুমাত্র সকালে এসে সন্ধ্যায় ফিরে যেতে নয়। এর ফলে বাড়বে স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান। স্থানীয়দের সঙ্গে ট্যুরিস্টদের সম্পর্কে তৈরি হবে এক নতুন ভারসাম্য।

এই ট্যুরিস্ট ট্যাক্স বসানোর প্রেক্ষিতটা একটু বিশদে দেখা যাক। বহুদিন ধরেই অতিরিক্ত পর্যটকের ভিড়ে ভেনিসের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রে হয়ে চলেছে অপূরণীয় ক্ষতি। গত বছর ভেনিস অল্পের জন্য ইউনেসকোর ‘ডেঞ্জার লিস্ট’-এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। ভেনিসের প্রধান দ্বীপটি একসময় ছিল এক শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত তার জনসংখ্যা কমেছে ১ লক্ষ ২০ হাজার। ভেনিস ছেড়ে প্রধানত ইতালির মূল ভূখণ্ডে পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। জনসংখ্যা কমতে কমতে এসে ঠেকেছে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি। ২০২২-এর হিসেব অনুসারে ভেনিসের ঐতিহাসিক কেন্দ্রস্থলে সে বছর রাত্রিবাস করেছেন ৩২ লক্ষ পর্যটক। ওদিকে, ডে-ট্রিপারের সংখ্যা মোটামুটি ৩ কোটি। যেদিন তিরিশ-চল্লিশ হাজার দৈনিক ভ্রমণকারী হাজির হন শহরটাতে, হাঁসফাঁস করতে থাকে শহরটা। এই ডে-ট্রিপাররা খাওয়াদাওয়া করেন, ঘোরাঘুরি করেন, গন্ডোলায় চড়েন, স্যুভেনির কেনেন ঠিকই কিন্তু হিসেব করে দেখা গিয়েছে যে মোটের উপর এঁরা শহরের অর্থনীতিতে যতটা না অর্থ জোগান তার চাইতে বেশি জোগান দেন শহরের পরিবেশে কোলাহল এবং আবর্জনা। তাই বোধকরি এঁদের নিয়ন্ত্রণ করার একটা প্রয়াস এই প্রবেশমূল্য।

১৯৬০-এর দশকে যখন বোঝা গেল যে ভেনিস শহরটা ধীরে ধীরে ডুবছে, ব্রিটিশ লেখক ইয়ান মরিস কিংবা জেমস ক্যামেরন প্রকাশ করেছেন তাঁদের বিষাদপূর্ণ উচ্ছ্বাস, সত্যিকারের ভেনিসকে দেখেছেন এমন শেষ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে। পর্যটকদের সঙ্গে একটা টেকসই সম্পর্ক স্থাপনে ভেনিসের প্রচেষ্টা তাই দীর্ঘদিনের। ইউনেসকো আর পরিবেশবিদদের চাপে আধিকারিকরা শেষ পর্যন্ত বড় জাহাজকে গিউদেকা ক্যানাল দিয়ে সেন্ট মার্কস স্কোয়ারের পাশ দিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন।

ট্যুরিস্ট-নন্দিত অন্যান্য শহরের দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। লন্ডন, আমস্টারডাম, প্যারিস, ফ্লোরেন্স, রোম, বার্সেলোনার মতো শহরগুলিও কিন্তু হাঁসফাঁস করছে পর্যটকদের চাপে। এই তো সম্প্রতি স্পেনের ক্যানারি আইল্যান্ডের হাজার হাজার অধিবাসী শামিল হলেন প্রতিবাদে, যাতে এই দ্বীপপুঞ্জে পর্যটকদের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়। সেভিল শহরের প্রধান প্লাজা অর্থাৎ প্লাজা দে এসপানা-তে ঢুকতে এখন টিকিট লাগছে। আমস্টারডাম আর রোম আর কোচ পার্টি চাইছে না। বার্সেলোনার দেওয়ালে গ্রাফিটি দেখা যাচ্ছে, শরণার্থীরা আসুক, পর্যটক নয়। তাই এটা দেখার বিষয়, এইসব বড় শহরগুলি ভেনিসের দেখানো পথে উদ্বুদ্ধ হয়ে শহরে ঢোকার টিকিট চালু করে কত শিগগির। আমার সেই ইতালীয় বন্ধুকে ই-মেল করেছিলাম সম্প্রতি, ভেনিস সম্পর্কিত তার ভবিষ্যদ্বাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। উত্তরে তিনি লিখলেন, গোটা ইতালি দেশটাই, অন্তত যে জায়গাগুলি পর্যটকদের প্রিয়, হতে চলেছে ‘থিম পার্ক’!

দুনিয়ার প্রথম বড় শহর হিসেবে ভেনিস প্রবেশমূল্য চালু করলেও ওয়েলশের ছোট্ট শহর পোর্টমেইরিয়ন কিন্তু এ ধরনের প্রবেশমূল্য চালু করেছে আগেই এবং সে শহরে কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে ট্যুরিস্টের আনাগোনা। আসলে এই প্রবেশমূল্যটা হয়তো’ প্রথম পদক্ষেপ। কে বলতে পারে, এর বিস্তৃতি কোথায়। যেমন- ইতালির আর একটা ছোট্ট শহর ব্যাগনোরেইয়ো-র কথা ধরা যাক, যা রোমের উত্তর-পশ্চিমে লাজিও অঞ্চলে অবস্থিত। মাটি ধসে এই শহরটার অস্থির ভিত্তি বসে যাচ্ছিল। শহরটাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১৮-তে পর্যটকদের উপর চাপানো হয় লেভি এবং কাজও হয় তার ফলে। সুতরাং পর্যটনে কর বসানোর সম্ভাবনা বহুল-বিস্তৃত। ভারতের মতো দেশে যেখানে ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি, সেখানে এমন পর্যটনযোগ্য স্থান রয়েছে ভূরিভূরি। এদেশেও কি ভবিষ্যতে বিভিন্ন শহরে আসতে চলেছে প্রবেশমূল্য?

তবু টানাপোড়েন চলতেই থাকে। সম্প্রতি ‘দ্য গার্ডিয়ান’ কাগজে সাইমন জেনকিন্স লিখেছেন, ‘আমি যদি ভেনিস হতাম, আমার কোনও লজ্জা থাকত না। প্রাচীন স্থান পরিদর্শন করা একটি গৌরবময় আনন্দ। যাঁরা তা উপভোগ করবেন তাঁদের তার উপযুক্ত মূল্য দেওয়া উচিত।’ হয়তো’ ঠিকই। তবু, শহরের অধিবাসীদের কাছে একটা ‘থিম পার্ক’-এর বাসিন্দা হওয়াটাও এক চূড়ান্ত অস্বস্তিকর দিনযাপন। এক ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা চলে।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Narendra Modi | শিলিগুড়ির রামকৃষ্ণ মিশনে হামলা, জনসভা থেকে তীব্র নিন্দা মোদির

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাধুদের একাংশের বিরুদ্ধে সরাসরি বিজেপির…

20 mins ago

Ebrahim Raisi | রাইসির মৃত্যুতে উৎসব পালনে ইরানিরা! পুড়ল আতশবাজি, ছড়াল মিম

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রবিবার পাহাড়ে ধাক্কা লেগে চপার ভেঙে মৃত্যু হয়েছে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম…

22 mins ago

Siliguri | খাদ্যে বিষক্রিয়ার জেরে মৃত্যু ব্যক্তির, অসুস্থ পরিবারের ৪

শিলিগুড়ি: খাদ্যে বিষক্রিয়ার (Food Poisoning) জেরে মৃত্যু হল ৫১ বছরের এক ব্যক্তির। অসুস্থ পরিবারের আরও…

31 mins ago

Chhattisgarh | ছত্তিশগড়ে পিকআপ ভ্যান উল্টে মৃত ১৫, আহত ৮

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ছত্তিশগড়ে পিকআপ ভ্যান উল্টে মৃত্যু হল ১৫ জনের। সোমবার ছত্তিশগড়ের কাদিরধাম…

32 mins ago

Cyclone | বঙ্গোপসাগরে ঘনাচ্ছে নিম্নচাপ, শুক্রবার থেকে ঝড়-বৃষ্টির সতর্কতা রাজ্যে

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বঙ্গোপসাগরে ঘনাচ্ছে নিম্নচাপ। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব…

36 mins ago

Mallikarjun Kharge | খাড়গের মুখে কেন কালি? রিপোর্ট চাইল ক্ষুব্ধ কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্ব

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস দপ্তরে সামনে কংগ্রেস সভাপতি খাড়গের (Mallikarjun Kharge) ছবি,…

37 mins ago

This website uses cookies.