- সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
দিন দুই বাদে প্রজাতন্ত্র দিবস। ভারতের অবস্থার প্রেক্ষিতে একটি পুনঃপুন বলার মতো গল্প। সেটি একটি চৈনিক গল্প। ভারতের এই মনোরম প্রেক্ষিতে গল্পটি আর একবার মনে করিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। আসলে লোককাহিনীর এই গুণ, সব কালেই প্রাসঙ্গিক। তার অর্থ, মানুষের সব কালই এক কাল। কালে কালে সেই একই মানুষের লীলাখেলা।
মিং রাজত্বকালে শানডং প্রদেশে এক ধনী ব্যক্তি বাস করতেন। তাঁর একটি ছেলে ছিল। মা-বাপের অতি আদরে ছেলেটি বখে গিয়েছিল। লেখাপড়া কিছুই শিখল না। খায়-দায় আর আড্ডা-ইয়ার্কি মেরে বেড়ায়। প্রতিদিনই সে পান ভোজ শেষ করে শহরের পথে চরতে বেরোয়। তার হাতে থাকে সুদৃশ্য একটি খাঁচা, আর সেই খাঁচায় একটি পাখি। তাকে তার আসল নামে আর কেউ ডাকে না। সবাই বলে, পাখি।
একদিন শহরের রাজপথ ধরে সে চলেছে। নিষ্কর্মা, মূর্খ, সেই ধনীর সন্তান। পথের একপাশে বসেছে জ্যোতিষী। রোজ বসে। দু’দশ টাকার বিনিময়ে মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেয়। যথারীতি তাকে ঘিরে মানুষের জটলা। পাখি ভাবল, যাই দেখি, মজাটা কেমন জমেছে। ভিড় ঠেলে সামনে দাঁড়াতেই গণকঠাকুর চিনে ফেলেছে। আরে এই তো সেই বড়লোকের বেটা! সঙ্গে সঙ্গে গণক একটা মতলব ভেঁজে ফেলল। পাঁঠাটাকে আচ্ছাসে তোয়াজ করে কিছু পয়সা হাতিয়ে নেওয়া যাক। পাখিকে ডেকে গণক বলছে, আরে এসো, এসো ভাই। এতদিন ছিলে কোথায়! তোমার কথা আমি যে রোজই ভাবি, যার এমন সুন্দর ধারালো দুটো চোখ, ধনুকের মতো দুটো মোটা ভুরু, তুমি তো ভাই রাজনীতিতে গেলে মারমার, কাটকাট করে ফেলবে। কোথায় যে উঠে যাবে, তুমি নিজেই জানো না। কোনও দিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কপালটা দেখেছ ভাই। অত চওড়া উঁচু কপাল ক’জনের হয়! এ তো রাজার কপাল! তুমি যদি বেজিং-এ গিয়ে রাজদরবারের পরীক্ষায় বসতে, তাহলে আমার বিচারে তুমি ফার্স্ট হতে। আর সরকারের সবচেয়ে উঁচু পদটি হত তোমার। নিজের ভাগ্য নিজেই জানো না ভাই, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছ অকাজে। তোমাকে আমি আমার আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি।
পাখি যদি গোমূর্খ না হত, লোকটির এই চাটুকারিতার জবাব দিত, দু’গালে ঠাস ঠাস করে গোটাকতক চড় মেরে। পাখি মনে মনে ভীষণ খুশি হয়ে বাড়ি চলে এল। আসার আগে জ্যোতিষীকে ভালো করে জিজ্ঞেস করে এল, তুমি কি নিশ্চিত যে, আমার দ্বারা পরীক্ষা পাশ সম্ভব? -শুধু নিশ্চিত নই, প্রথম তিনজনের মধ্যে তোমার নাম থাকবেই থাকবে। -এখন তোমাকে দুশো টাকা দিচ্ছি। যদি তোমার ভবিষ্যদ্বাণী মেলে, তাহলে আরও পাবে। আর যদি না মেলে, তাহলে সুদে-আসলে তোমার সবক’টা দাঁত উপড়ে নেব।
জ্যোতিষী মনে মনে ভাবলেন, যবে তুমি রাজা হবে, তখন আমি চিতায়, কার দাঁত ওপড়াবি রে পাঁঠা!
পাখি চলেছে বেজিং-এ উচ্চ রাজপদের নির্বাচনি পরীক্ষায় বসবে বলে। একবারও মাথায় এল না, তার মতো ক-অক্ষর গোমাংস, এক মহামূর্খ কী করে পরীক্ষায় বসতে পারে!
বেজিং-এ পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেশ রাত হয়ে গেল। আবার সেই দিনই পরীক্ষার শেষ দিন। রাজধানীতে প্রবেশের পশ্চিম সিংহদুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। পাখি কিছুই জানে না। সে দেখলে সার সার জলের গাড়ি চলেছে। মিং আর কিং ডাইনাস্টির রাজারা প্রস্রবণের জল পান করতেন স্বাস্থ্যের কারণে। দূরে একটা পাহাড় ছিল, সেই পাহাড়ে ছিল জেড স্প্রিং। জল আসছে সেইখান থেকে। পাখি আসছিল ঘোড়ায় চেপে। জলের গাড়ির পিছন পিছন সে শহরে ঢুকে পড়ল। প্রহরীরা বাধা দিল না, ভাবল রাজপ্রাসাদের প্রহরী জলের গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
শহরে তো ঢুকল, কিন্তু কিছুই জানে না, কোথায় কী আছে! পরীক্ষাকেন্দ্র কোথায়, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়াল। বেড়াতে বেড়াতে এসে পড়ল শহরের চৌমাথায়। সেখানে এসে দেখছে লন্ঠন হাতে একদল লোক আসছে। তাদের মাঝখানে রয়েছেন স্বয়ং রাজকুমার। তারা বেরিয়েছে শহরে রাতের চৌকি দিতে। এত লোককে একসঙ্গে আসতে দেখে পাখির ঘোড়া গেল খেপে। লাগাম টেনেও বাগে রাখা গেল না। পাখির ঘোড়া গিয়ে পড়ল রাজকুমারের ঘোড়ার ঘাড়ে।
এই রাজকুমার রাজার অতিশয় প্রিয়, ফলে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এবং বদমেজাজি। ইচ্ছে করলে তখনই তরোয়ালের এককোপে পাখিকে খতম কতে দিতে পারত। কিন্তু রাজকুমারের কৌতূহল জাগল, মারার আগে জানা দরকার এই উজবুকটা কে?
রাজকুমার তার নিজের ঘোড়ার রাশ সংযত করে প্রশ্ন করল- এই যে ছোকরা, বেঁচে থাকায় বিরক্তি ধরে গেছে বুঝি?
পাখি তো কিছুই জানে না, কোন দোর্দণ্ডপ্রতাপের সঙ্গে কথা বলছে। পাখি চিত্কার করে উত্তর দিলে, আমার সঙ্গে ওইভাবে কথা বলবে না। সাবধান করে দিচ্ছি। জানো না, আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি। – কী কাজে মানিক? -আমি সেই শানডং থেকে সারাদিন ঘোড়া ছুটিয়ে আসছি। আমাকে রাজদরবারের পরীক্ষায় বসতে হবে। যদি আমার দেরি হয়ে যায়, তাহলে প্রথম তিনজনের মধ্যে আমার নাম থাকবে না। -প্রথম তিনজনের মধ্যেই যে তোমার নাম থাকবে, তুমি এতটাই নিশ্চিত? -তা না হলে অতদূর থেকে আমি পরীক্ষা দিতে ছুটে আসব কেন?
রাজকুমার মনে মনে ভাবল, বেটা ভাঁওতা মারছে, প্রথম তিনজনের একজন হবে, এতই পণ্ডিত তুমি? বেশ, একটা সুযোগ দেওয়া যাক। ধাপ্পা ধরা পড়লে কচুকাটা করতে কতক্ষণ! রাজকুমার তখন তার পার্ষদদের হুকুম করল- এই, আমার একটা পরিচয়পত্র একে দিয়ে দে, যাতে বিনা বাধায় পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারে। তোদের একজন গাইড হয়ে এই ছোকরার সঙ্গে যা।
পাখি তো মহাখুশি। গাইড আগে আগে, পাখি তার পরিচয়পত্র দোলাতে দোলাতে পিছে পিছে। টোকা মারতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন দুই প্রধান শিক্ষক। পরিচয়পত্র দেখে দুই প্রধান শিক্ষকের একজন লাফিয়ে উঠলেন- ওরে ব্বাবা, এ তো খোদ রাজকুমারের পরিচয়পত্র। নিশ্চয় তাঁর কোনও আত্মীয়। একে তো ঢুকতে দিতে হবেই। দ্বিতীয় পরীক্ষক বললেন, তা কী করে হয়, আমার কোনও ঘরেই তো কোনও জায়গা নেই। শলাপরামর্শে অবশেষে ঠিক হল, প্রধান পরীক্ষক দুজন তাঁদের ঘরটি পাখিকে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা বাইরে রাত কাটাবেন। রাজকুমারের আত্মীয়কে কি ফেরানো যায়! তাহলে ধড়ে মুণ্ড থাকবে না।
পাখি ঠাঁই পেল। প্রথম পরীক্ষক বললেন, তাহলে ওকে কাগজ আর প্রশ্ন দেওয়া যাক। দ্বিতীয় পরীক্ষক বললেন, দাঁড়াও, কোন বিষয়ে প্রশ্ন দেবে? ওর বিষয়টাই তো জানা হল না।
জিজ্ঞেস করার সাহস হল না দুজনেরই। রাজকুমারের আত্মীয় বলে কথা! বিষয়টা তো তাঁদের আগে জানা উচিত ছিল। তখন দুজনে ঠিক করলেন, তাঁরাই সব উত্তর লিখে মুখ্য পরীক্ষকের কাছে খাতা জমা দেবেন। তাই হল। পাখি পড়ে পড়ে ঘুমোল। পরীক্ষকরা তাকে প্রথমই করতেন, কিন্তু চক্ষুলজ্জার কারণে তাঁরা পাখিকে দ্বিতীয় স্থান দিলেন।
ইতিমধ্যে পাখি জানতে পেরেছে, যার পরিচয়পত্রের জোরে এত কাণ্ড, সে হল এই রাজ্যের ক্ষমতাশালী রাজকুমার। পাখির আর কিছু না থাক, কুচুটে বুদ্ধির অভাব ছিল না। দামি দামি উপহার নিয়ে সে রাজকুমারের বাড়িতে হাজির। পাখি প্রহরীর হাতে তার নামে কার্ড আর উপহারের একটা তালিকা ভিতরে পাঠিয়ে দিল। রাজকুমার মানুষটাকে ভুলে গেলেও উপহারের তালিকা দেখে বেজায় খুশি। প্রহরীকে বললেন, এক্ষুনি ভিতরে নিয়ে আয়। পাখি বলল, সেদিন আপনি পরিচয়পত্র দিয়ে পরীক্ষায় বসতে সাহায্য না করলে আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে পারতুম না।
রাজকুমার ভাবলেন, বাবা, এ তো সত্যিই মহাপণ্ডিত, তাই সেদিন অত বোলচাল মারছিল। আমি যখন সম্রাট হব, তখন একে আমার কাজে লাগবে। বরং এর খাতিরে এখুনি একটা মহাভোজের আয়োজন করা যাক।
সাংঘাতিক পান-ভোজনের পর পাখি বিদায় নিল। বিদায় জানাতে স্বয়ং রাজকুমার পর্যন্ত এলেন। সারা বেজিং-এ এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। পাখির জয়জয়কার। রাজকর্মচারীরা এইবার একযোগে সম্রাটের কাছে যৌথ আবেদন পাঠালেন- পাখির মতো একজন সুদক্ষ, মহাপণ্ডিতকে অবিলম্বে কোনও রাজপদে অভিষিক্ত করা হোক, দেশ তাতে উপকৃত হবে। সঙ্গে সঙ্গে ইম্পিরিয়াল অ্যাকাডেমিতে পাখি বড় পদ পেয়ে গেল। হিজ ম্যাজেস্টিজ সার্ভিস। না জানে লিখতে, না জানে পড়তে। ড্রাফট, মেমোরেন্ডাম, আর্টিকল, যা আসে পাখি একবার দেখেই বলে, বাঃ বাঃ, খুব ভালো, তুলনা নেই।
এই কায়দায় বেশ চলছিল। এসে গেল রাজকুমারের জন্মদিন। সবাই সব নানা উপহার নিয়ে হ্যাপি বার্থ-ডে করতে যাচ্ছে। পাখিও রয়েছে সেই দলে। সে অনেক কিছু কিনেছে, সেইসঙ্গে কিনেছে বিশাল বড় একটা স্ক্রোল।
একজন জিজ্ঞেস করল, ও মশায়, এটাও কি উপহার? অবশ্যই। তা, কিছু একটা লিখুন। কিছুই তো লেখেননি। এই সুযোগে আপনার হস্তাক্ষর প্রথম দেখার সৌভাগ্য হবে আমাদের। আমার সবই ভালো ভাই, কেবল হাতের লেখাটাই তেমন সুবিধের নয়। তুমিই লিখে দাও। রাজকর্মচারীটি মনে মনে বলল, দাঁড়া ব্যাটা, তোর মজা দেখাচ্ছি। সে বড় বড় করে লিখল, হে রাজকুমার, তোমার কীর্তিকাহিনী আমাদের জানা আছে। পুরাকালের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজকুমারের মতো, তুমিও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। হে নরাধম, তুমি সম্রাটকে হত্যা করে সিংহাসনে বসতে চাইছ। সিংহের আসনে শৃগাল! ধিক ধিক! পাখি লেখাটা দেখে তার সেই এক পেটেন্ট মন্তব্য করল- বাঃ বাঃ, বহুত সুন্দর!
রাজকুমারের ঘরের দেয়ালে স্ক্রোলটা ঝুলে গেল। রাজকুমার লেখাটার দিকে তাকালই না। অন্য সবাই পড়ছে, কিন্তু সাহস করে কেউ কিছু বলছে না। সবাই জানে, বললেই মুণ্ডচ্ছেদ। ও লিখেছে, আর তুমি পড়েছ, দুজনেরই এক গতি।
লেখাটা ঝুলেই রইল। এদিকে রাজকুমারের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেল। তল্লাশি করে তার ঘর থেকেই বেরোল সম্রাটের পোশাক আর তরোয়াল। সম্রাট আদেশ দিলেন, সবক’টা ষড়যন্ত্রীকে ঝুলিয়ে দাও। যেহেতু পাখি তার পছন্দের লোক, পাখিরও প্রাণদণ্ড।
তখন এক রাজসভাসদ নতজানু হয়ে সম্রাটকে নিবেদন করলেন ষড়যন্ত্রের খবর তো পাখিই প্রথম ফাঁস করে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রাজকুমারকে লিখিত ধিক্কারও জানায়। সেই লেখা আজও ঝুলছে। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তিন ধাপ প্রোমোশন। রাজকুমার ঝুলে গেল, পাখি উঠে গেল তিন পদ ওপরে।