Monday, May 20, 2024
Homeজাতীয়যোগীতেই মন মজে লখনউয়ের বাঙালিদের

যোগীতেই মন মজে লখনউয়ের বাঙালিদের

রূপায়ণ ভট্টাচার্য, লখনউ: হুসেইনগঞ্জ মেট্রো স্টেশন থেকে একটু এগোলে লখনউয়ের পুরোনো হিউইট রোড। রাস্তার মধ্যে একটি গলি ঢুকে গিয়েছে অনেকটা। রবীন্দ্র জয়ন্তীর সন্ধেয় সেখান দিয়ে লাল-হলুদ শাড়ি পরা খুদে বালক-বালিকার দলকে যেতে দেখা গেল। যেন রাস্তাটা জলপাইগুড়ি, বালুরঘাট বা কোচবিহারের মতো বাংলার কোনও সংস্কৃতিমনস্ক শহরের।

রাস্তাটার নাম বদলে শিবাজী মার্গ হয়ে গিয়েছে এখন। নানা ধরনের দোকান। তার মাঝে বেঙ্গলি ক্লাব ও যুবক সমিতি লেখা গেটটি দেখে এগোলে এক অত্যাশ্চর্য দুনিয়ায় পৌঁছে যাবেন। পঁচিশে বৈশাখের সন্ধেয় ক্লাবের মঞ্চে মাইক টেস্টিং হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে। আস্তে আস্তে মঞ্চের সামনের চেয়ারগুলো ভরে উঠছে। মঞ্চের পাশে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে ফুল দিচ্ছেন সবাই। মঞ্চের একদিকে টাঙানো অতুলপ্রসাদ সেনের ছবি। ১৯০৩ থেকে ১৯৩৪, আমৃত্যু তিনি ছিলেন এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।

৯২ বছরের এক লখনউ প্রবাসী প্রাক্তন আইএএস বঙ্গসন্তান গান গেয়ে পাঠিয়েছেন মোবাইলে। ‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার।’ সেটা শোনানো হল শুরুতে। তারপরই দুই বালক-বালিকা মঞ্চে নাচতে শুরু করল, ‘হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে।’ বাংলা থেকে এত দূরে, অতুলপ্রসাদ সেনের প্রাণের শহরে এখনও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বেঁধে রাখেন রবীন্দ্রনাথ।

এই মঞ্চেই ১৯৩৮ সালের ২০ নভেম্বর সুভাষচন্দ্র বসুকে সংবর্ধনা দিয়েছিল বেঙ্গলি ক্লাব। দেখলাম, এখনও তাঁকে দেওয়া চমৎকার অভিনন্দনপত্রটি বাঁধিয়ে টাঙানো আছে ক্লাবের ঘরে। সেই অভিনন্দনপত্রে বোঝা যায়, কীভাবে তারও পঞ্চাশ বছর আগে থেকে অতুলপ্রসাদের নেতৃত্বে ‘বেঙ্গলি ইয়ংমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার ঊর্ধ্বে উঠে বাংলা ও তদানীন্তন যুক্তপ্রদেশের দুর্ভিক্ষ, বন্যা, ভূমিকম্পপীড়িতদের সাহায্যে কাজ করতেন।

শহরে আড়াই থেকে তিন লাখ বাঙালি আছেন এখনও। প্রতিদিন তাঁরা টিভিতে বাংলা সিরিয়াল ও বাংলা খবর দেখেন। বাংলার মতো একই রোগ আবির্ভূত সেখানে। পরবর্তী প্রজন্ম চাকরি করতে বাইরে চলে যাওয়ায় মা-বাবা ভুগছেন একাকিত্বে। বহু আগে এই এলাকায় বাঙালিরা থাকতেন। এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। একদল রবীন্দ্রপল্লি বানিয়ে উঠে গিয়েছেন শহরের অন্য প্রান্তে।

মোদি-যোগীর রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে এই বাঙালিরা কী ভাবেন, তা জানতে কথা হল কয়েকজনের সঙ্গে। টেবিল টেনিসের প্রাক্তন সর্বভারতীয় কর্তা  অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। ছিলেন নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের লখনউ শাখার প্রধান এনাক্ষী সিংহ, তিনিই রবীন্দ্র সন্ধ্যার প্রধান অতিথি। আরও অনেক বাঙালি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, বাঙালিদের অধিকাংশ ভোট পাবে বিজেপি। কোনও বিকল্প নেই। অতীতে কংগ্রেসের পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির অনেক বাঙালি সমর্থক ছিলেন এ শহরে। আস্তে আস্তে তাঁরা বিলীন। এসপি বা বিএসপিকে প্রবাসী বঙ্গসন্তানদের পছন্দ নয় একেবারে।

১৯৬৬-’৬৭ সালে সত্যজিৎ রায় যে সময় লখনউকে কেন্দ্র করে বাদশাহী আংটি লিখেছিলেন, সেই সময়ের তুলনায় আমূল পালটেছে শহর। অতি স্বাভাবিক। গল্পে ফেলুদার দেখা হয়েছিল ডাক্তার শ্রীবাস্তব ও পেয়ারেলালের সঙ্গে। যাঁদের বাড়িতে ছিল আওরংজেবের অমূল্য আংটি। ডাক্তারের প্রতিবেশী বনবিহারীবাবুর বাড়িতে ছিল ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। যেখানে কুমির, বাঘ, হায়না, রাটলস্নেক, কাঁকড়াবিছে ও ব্ল্যাক উইডো মাকড়সা পোষা হত।

এখনকার দিনে ওরকম দৃশ্য দেখা মুশকিল। নিয়মেই আটকে যাবে। তবে এক বাঙালি চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা হল, যাঁকে লখনউয়ে সবাই এক ডাকে চেনেন- শুভাশিস মুন্সি। চিত্তরঞ্জনে জন্ম, ১৯৬৭ থেকে এখানে। অসম্ভব জনপ্রিয়। বলছিলেন, ‘আমি গোটা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেও লখনউকে সবচেয়ে ভালোবাসি। এখানকার মানুষের মনগুলো আসলে খুব ভালো।’ একটা জিনিস তাঁকে সবচেয়ে যন্ত্রণা দেয় মনে হল, ‘সিন্ধি, মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবিদের কেন্দ্রীয় সংস্থা রয়েছে। এখানে বাঙালিদের অনেকগুলো সংগঠন।’

মৃত্যুর নব্বই বছর পরে লখনউয়ে আজও প্রাসঙ্গিক অতুলপ্রসাদ। চারবাগে লখনউ স্টেশনের কাছে এখনও এপি সেন রোডটি প্রবল বিক্রমে দাঁড়িয়ে। তবে অনেক বাঙালিরই দুঃখ, অতুলপ্রসাদের রাজকীয় বাড়িটি আর রাখা সম্ভব হয়নি। হাতবদলের পর ভেঙে তৈরি হয়েছে অন্য বাড়ি। আগের চিহ্ন নেই কোনও। রাজনৈতিক জীবনে অতুলপ্রসাদ ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলের খুব কাছের লোক, কংগ্রেসের লোক। লখনউয়ে তাঁর বঙ্গ উত্তরসূরিদের রাজনৈতিক ভাবনায় আজ আর কংগ্রেস নেই। তেমন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নেই বলেই নেই। যোগীর পার্টি বাঙালিদের ভোট পাবে হাতের কাছে অন্য বিকল্প নেই বলে।

২০১৭ থেকে মুখ্যমন্ত্রী যোগী। উত্তরপ্রদেশে এত ঘনঘন কুর্সিবদল হত যে, আগে কেউ ছয় বছর টানা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না এতদিন। তাঁর মধ্যে কী ভালো গুণ দেখছেন রাজ্যের রাজধানীর বাঙালিরা? দুটো-তিনটে অতি সহজ ব্যাখ্যা বারবার বেশি করে উঠল কথাবার্তায়।- ১) আইনশৃঙ্খলা অনেক ভালো এখন। মুলায়ম সিং যাদব-মায়াবতী-অখিলেশ যাদব মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় লখনউয়ে দাদাগিরি চলত প্রচুর। তা এখন বন্ধ। ২) তিনজন মিলে আটবার মুখ্যমন্ত্রী হলেও কোনও স্থিরতা দিতে পারেননি। ৩) ক্রাইম রেট কমার পাশে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে অনেক উন্নয়ন করতে পারছে যোগী সরকার। গ্রামে তেমন উন্নয়ন না হলেও শহরে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে। ৪) মায়াবতীর আমলে বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি শহরের প্রচুর গাছ কাটা হয়েছিল। এখন লখনউয়ে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। শহর অনেক সুন্দর। ৫) গোমতী নদীর সংস্কার এতদিনে হয়েছে। যা মুলায়ম-মায়াবতীরা পারেননি। ৫) ছোট-বড় রাস্তা এখন অনেক সাজানো, পরিচ্ছন্ন। অনেক রাতেও নিরাপদ।

যোগীরাজের শাসনে বুলডোজার রাজকে কীভাবে দেখছে মানুষ? কালই ফারুকাবাদ কেন্দ্রে মুখ্যমন্ত্রীর সভা ছিল। একদল বিজেপি কর্মী অনেক বুলডোজারে চড়ে এসেছিল। তাতে পার্টির পতাকা লাগােনা। ব্যাপারটা নিয়ে এত উন্মাদনা ছিল যে, সভায় ভাষণ শোনার আগ্রহ ছিল না অনেকের। যোগীর একনায়কতন্ত্র নিয়ে আলোচনায় সমালোচনা উঠল। কিন্তু অধিকাংশই শুনলাম বলছেন, আইনশৃঙ্খলার ঝাঁকুনিটা দরকার ছিল। এর মধ্যে একটা জিনিস স্পষ্ট। দলিতদের রাজনীতির সঙ্গে কোনওভাবেই নিজেদের মেলাতে নারাজ পাহাড়ি সান্যালদের উত্তরসূরিরা। বরং থাকতে থাকতে তাঁদের মধ্যেও কোথাও যেন উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্গের ভাবনা গ্রাস করেছে। উচ্চবর্গের সঙ্গে বিজেপির রাজনীতি বেশি মেলে গোবলয়ে।

হজরতগঞ্জে জেলা শাসকের বাংলোর কাছে সরোজিনী নাইডু পার্কে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে এখনও টাটকা কিছু মালা পড়ে। লখনউ শহরের বেশ কিছু বাঙালি সংগঠন বুধবার মালা দিয়েছে সেখানে। প্রবাসী বঙ্গ সাংস্কৃতিক সমিতির সদস্যরা রবীন্দ্রসংগীত করেছেন ছোট অনুষ্ঠানে। এই মার্চেই একশো বছর পূর্তি হল রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় লখনউ যাত্রার। অতুলপ্রসাদ সে সময় তাঁর সম্মানে এক সংগীত দরবার বসিয়েছিলেন নবাবি শহরে। মূর্তির নীচে দাঁড়িয়ে ভাবার চেষ্টা করছিলাম, এই শহরে আজ আবির্ভূত হলে রবীন্দ্রনাথ-অতুলপ্রসাদ তাঁদের উত্তরসূরিদের বর্তমানের উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের রাজনীতি নিয়ে কী বলতেন।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Lok Sabha Elections 2024 | দিনভর বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা! দিনের শেষে শান্তিতেই ভোট, দাবি কমিশনের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বিক্ষিপ্ত কিছু উত্তেজনার ঘটনা ছাড়া মোটের উপর শান্তিতেই মিটল পঞ্চম দফার ভোটপর্ব। এদিন রাজ্যে মোট ৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।...

Bengal Police | পঞ্চম দফা ভোটের দিনই অপসারিত পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি, খোঁচা অভিষেকের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ভোটের (Lok Sabha Election 2024) আবহে রাজ্য পুলিশে (Bengal Police) রদবদল অব্যাহত। এবার পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার (Paschim Medinipur SP)...

NBU Researcher Death | গবেষক ছাত্রীর রহস্যমৃত্যুতে অধ্যাপকের হাত! অভিযোগ ঘিরে বিক্ষোভ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে

0
শিলিগুড়ি: উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে এসে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তরুণী ছাত্রী ববিতা দত্তের। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল ববিতার ঝুলন্ত দেহ। কিন্তু...

Asansol | দামোদর নদীতে ডুবে মৃত্যু স্কুল পড়ুয়ার,শোকের ছায়া এলাকাজুড়ে

0
আসানসোল: বন্ধুদের সঙ্গে দামোদর নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হলো এক স্কুল পড়ুয়ার। রবিবার ঘটনাটি ঘটেছে আসানসোলের হিরাপুর থানার অন্তর্গত বার্ণপুরের ভুতাবুড়ি...

Maoist Attack | ওডিশার জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে গুলির লড়াই, জখম জওয়ান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ভোটের আগেই উত্তপ্ত ওডিশা। সোমবার কালাহান্ডি লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত নুয়াপাড়ার পাহাড়, জঙ্গল ঘেরা এলাকায় হামলা চালায় মাওবাদী গেরিলা বাহিনী। মাওবাদীদের...

Most Popular