- শর্মিষ্ঠা ঘোষ
কে চায় যেচে বোকা হতে? বাজারের ভাষায় মুরগি হতে? আর এমন কোথায় লেখা আছে ভালো মানেই বোকা জোলা আর চালাকরা সব দুষ্টু শেয়াল? (উপেন্দ্রকিশোরের গল্প মনে পড়ে নিশ্চয়ই!)
কে করল এমন তরল ক্ল্যাসিফিকেশন আর কেনই বা? পয়লা এপ্রিল এবং এপ্রিল ফুলের প্রেক্ষাপটে ভারতকে রেখে এই প্রশ্নগুলো আরও মনে হয়। এই দেশে স্বাধীনতার পর থেকে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষকে তো বোকা বানিয়েই রাখা হয়েছে। মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সমাধান চিন্তাও কোনওদিন তাদের একত্র করতে পারেনি। এক হতে পারেনি বলেই তারা অনেকাংশে শাসিত হয়েছে অযোগ্য শাসকের দ্বারা।
হ্যাঁ, মানছি সেসব শাসকের একমাত্র যোগ্যতা ছিল তারা এই জনগণের থেকে অনেক চালাক। কিন্তু সাধারণ মানুষ বোকাই থেকে যাবে চিরকাল, শোষিত হবে শাসিত হবে এ কেমন চাওয়া ? এটা কেন প্রোমোট করছি আমরা? কার স্বার্থে? কেনই বা এমন পেছন ফেরা চিন্তা প্রোমোট করা হয়? জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধির সঙ্গে সচেতনতা যোগ হলে কোনও মানুষ আর বোকা থাকে না। হৃদয়ে আলো জ্বললে ভালোবাসতে শেখে।
যে মানুষ সুস্থ চিন্তা চেতনা উদারতা এবং মানবিকতার চর্চা করে, সে মানুষ শয়তান নয় বা দুষ্ট নয়। সে কখনও অন্যকে কষ্ট দেয় না বা বঞ্চিত করে না, ঠকায় না। এই সামান্য কথাটা কেন সরাসরি বলতে পারি না একটি শিশুকে ? একদা যে শিশুটি বলেছিল, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ সেও তো সরলই ছিল আসলে। এটাও কি বোকামি তবে? যে ‘সং অফ ইনোসেন্স’ এবং ‘সং অফ এক্সপেরিয়েন্স’ আমরা পড়ি, সেখানে ল্যাম্ব মানে ভেড়া এবং শিশু সারল্যের প্রতীক। সে যিশুখ্রিস্টের প্রতিরূপ। যে মানবসভ্যতার ভালোর জন্য প্রাণ দেবে। আর যে বাঘ, সে তার ভয়ানক হিংস্রতা কুটিলতার প্রতীক। সে আসলে মানুষের বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গে আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ দ্বারা দূষিত হয়ে যাওয়ারও প্রতীক। জীবন সংকট তাকে জটিল করে তোলে।
অধিকাংশ শিশু সরল এবং সত্যবাদী। কিন্তু তারা বোকা হোক একদম চাইবেন না কেউ। সে ন্যায় শিখুক। প্রতিবাদ শিখুক। প্রতিরোধ শিখুক। পিতৃপুরুষের অপমান বঞ্চনার প্রতিশোধ নেওয়া শিখুক। শিখুক ক্ষমা করাও। ক্ষমা এবং উদারতাও কিন্তু বোকামি নয় কোনও অর্থেই। আমাদের অভিধানে বোকা মানে ভালো নিশ্চয়ই নয়। ছিল না। আমরা যারা নতুন প্রজন্মকে এমন ভুল অর্থ শেখাচ্ছি তারা আসলে কী চাইছি? নতুন প্রজন্মকে ক্ষমতা এবং বলদর্পীর হাতের পুতুল করে তৈরি করতে চাওয়াটা অন্যায়। যেখানে প্রশ্ন থাকবে না? চেতনা থাকবে না? শিশুরা বড় হয়ে অনেক কিছু হতে চায়। আজ যে বোকা হতে চাইছে, কাল সে ভগৎ সিংয়ের মতো বা রবিন হুডের মতো হতে চায়। এপ্রিল ফুলের দিন বলা যায়, মানুষ সৎ সহজসরল সত্যবাদী হোক। যুক্তিনিষ্ঠ হোক। বোকা মানে কিন্তু সবসময় বোকা হওয়া নয়।
(লেখক সাহিত্যিক। রায়গঞ্জের বাসিন্দা)