রূপায়ণ ভট্টাচার্য
এই তো আর একটা মে মাস চলে যাচ্ছে। ঠিক একশো বছর আগের এমনই এক মে মাসে চিরকালের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন সুশীলাসুন্দরী নামে এক বঙ্গললনা। অকুতোভয়। অসমসাহসী।
সার্কাসের দলে প্রথম ভারতীয় তরুণী এই সুশীলা। তাঁকে বলা হত ফ্লাইং ট্র্যাপিজে উড়ন্ত পরি। ঘোড়ার সঙ্গে খেলতেন। হাতির সঙ্গে খেলতেন। সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল, দুটি বাঘের সঙ্গে আধ ঘণ্টা ধরে খেলতেন তাঁদের খাঁচায় ঢুকে। জড়িয়ে ধরতেন ওদের। চুমু খেতেন। বাঘেরাও তাঁকে চুমু খেত। বাঘেদের সামনের পা তুলে ধরে তাদের নাচাতেন।
এই সময়টা সে সময় হলে কী হত জানি না, প্রিয়নাথ বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে বাঘ দুটির নাম ছিল লক্ষ্মী ও নারায়ণ। সুশীলা এই বিপজ্জনক খেলায় নাও যেতে পারতেন। সার্কাসটা ছিল তাঁদেরই পারিবারিক ব্যবসা। প্রিয়নাথ ছিলেন সুশীলার স্বামী মতিলালের ভাই। তবু অ্যাডভেঞ্চারিজম সার্কাসে নিয়ে যায় তাঁকে। তিনিই ছিলেন সার্কাসের এক নম্বর আকর্ষণ।
একশো বছর আগে, মাত্র পঁয়তাল্লিশে প্রয়াত এক বঙ্গতরুণীর কথা বলছি। তাঁর স্বামী মতিলাল ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ক্লাসমেট, বন্ধু। তাঁদের বাড়ি ছিল বিবেকানন্দের বাড়ির কাছেই। বিধান সরণি ও বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। সার্কাসে সুশীলার বাঘের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া দেখে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘ভারতী’তে লিখেছিলেন, ‘একটি ক্ষুদ্র বালিকা নির্ভয়ে বাঘের মুখচুম্বন করিতে লাগিল। বাঘটি যেন তাহার একটি পোষা কুকুর।’ প্রায় কুড়ি বছর নানা বাঘের সঙ্গে খেলা দেখানোর পরে ফরচুন নামে একটি বাঘ সুশীলাসুন্দরীকে আক্রমণ করেছিল। সবে সে বাঘ নতুন এসেছিল। ক্ষুধার্ত ছিল। ট্রেনিং হয়নি ভালো। সুশীলা তাকে সামলাতে পারেননি। থাবা মেরে মেরে এতই রক্তাক্ত করেন, সুশীলা অবসর নিতে বাধ্য হন। আর সেরে ওঠেননি।
তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পর কল্পনা করা কঠিন, সুশীলাসুন্দরীর জনপ্রিয়তা তখন কতটা ছিল। তাঁর মৃত্যুতে কত লোক চোখের জল ফেলেছিল। সার্কাস এবং বাঘের খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর স্বামী মতিলালের আখড়ায় লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলা, কুস্তি, সাইক্লিংয়ে অংশ নিতেন সুশীলাসুন্দরী। অনেক ছাত্রছাত্রী ছিল তাঁর। পরে এই ছেলেমেয়েদের অনেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে বিপ্লবী হিসেবে কাজ করেছেন। মৃত্যুর আগে সুশীলা তৈরি করে গিয়েছেন অসংখ্য বিপ্লবী। বাঘের খাঁচার মধ্যে বসে আছেন সুশীলাসুন্দরী, কোনও সময় বাঘের গলায় চেন পরিয়ে হাঁটছেন- এমন দুটো ছবি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল তখন।
একশো বছর আগে প্রয়াত এক বাঙালি নারী নিয়ে আজ হঠাৎ লেখা শুরুর কারণটা কী? আধুনিক বং পাঠক পুরোনো দিনের কথা শুনতে চান না। উশখুশ করেন। এসবের বদলে বরং মহুয়া মৈত্র, লকেট চট্টোপাধ্যায়, দীপ্সিতা ধরদের নিয়ে িলখলে আজকাল সাগ্রহে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
সুশীলাসুন্দরীর কথা মনে পড়ল সম্প্রতি তিন শহরে তিন রাজ্যের তিন নারী মিছিলের পিছন পিছন হাঁটতে। আগ্রায় তাজমহল দেখার ভিড়ে একঝাঁক রাজস্থানি মহিলা যাচ্ছিলেন কার্যত লাইন দিয়ে। তাঁদের সামনে মুখিয়া জাতীয় তিন-চার পুরুষ। অযোধ্যায় রাম মন্দির থেকে হনুমান গরহি যাওয়ার মিছিলে উত্তরপ্রদেশেরই কনৌজের গ্রামের একঝাঁক মহিলা। সামনের দিকে দুই পুরুষ। পিছনে একজন। বারাণসীতে ওরকমই ছোট মিছিলে দেখি জনা পনেরো তািমল নারী। সালেম থেকে এসেছেন। তাঁদেরও সামনে পিছনে জনা তিনেক বয়স্ক পুরুষ। কিছু মনে করবেন না, তুলনাটা অত্যন্ত কুৎসিত শোনাতে পারে। দেখে মনে হচ্ছিল, সন্ধ্যার মুখে গৃহপালিত পশুদের নিয়ে বাড়ি ফিরছে গৃহস্থরা। পুরো মিছিলটাই শব্দহীন। প্রাণের কলকাকলি নেই। সবাই বাক্যিহারা।
এঁদের সরল মুখ দেখে দুম করে মনে পড়ে গেল, মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত দু’-তিনজন গুজরাটি ও রাজস্থানি বড় কর্তার মন্তব্য। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত। পেশায় সফল। অথচ সটান বলেন, ‘মেয়েরা পড়াশোনা করুক। তারপর চাকরি করে কী করবে? আমার বৌ-কে তো বলে দিয়েছি, চাকরি করার দরকার নেই। রানির মতো থাকো। টাকাপয়সা সব পাবে। সংসার করো।’ অতএব কাজ করছেন না এঁদের স্ত্রীরা। শপিং মলে ঘুরছেন। ইচ্ছেমতো চুটিয়ে বাজার করছেন। পড়াশোনা করা অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির পরেই গুজরাটে দু’বছর সাতাত্তর দিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অনাদিবেন প্যাটেল। পরে তাঁকে সরিয়েই দেওয়া হয়। সরোজিনী নাইডুর পর তিনি উত্তরপ্রদেশের দ্বিতীয় মহিলা রাজ্যপাল এখন। যোগীরাজ্যে কোনও কাজ নেই। সম্পূর্ণ আড়ালে। অথচ শুরুর দিকে ভালো কিছু কাজ করেছিলেন গুজরাটে।
সাম্প্রতিক বাংলার বেশ কিছু ঘটনা নিয়ে প্রচুর প্রবাসী বাঙালি ইদানীং অতীব সরব। বাংলার নাকি সর্বনাশ হয়ে গেল। বাংলার বাইরে যাঁরা থাকেন, তাঁরা বাংলা ও বাঙালির খুঁত ধরে ফেলতে সিদ্ধহস্ত। ভালো কিছু চোখে পড়ে না। হোয়াটসঅ্যাপের কিছু গ্রুপে প্রবাসী বাঙালিদের সকালটাই শুরু হয় বাংলার সামাজিক পরিস্থিতিকে গালাগাল দিয়ে। এঁরা যদি একবার নিজেদের বর্তমান রাজ্যে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান ভালো করে খতিয়ে দেখেন, তা হলে বুঝতে পারবেন, কতটা পিছনে তাঁরা পড়ে। বড় কারখানা, বড় রাস্তা গড়েও কোনও লাভ হয় না যদি আমাদের মাতৃকূল পিছনেই পড়ে থাকেন। সংসারে বন্দি থাকেন।
দক্ষিণ ভারত এ ব্যাপারে বাংলার মতোই উদার, আধুনিক। সাধারণভাবে শিক্ষিত হওয়ার পর গৃহবন্দিত্ব মেনে নেবেন না তাঁরা। পাহাড়ের মহিলারাও। কিন্তু গো বলয়ের এক বিশাল অংশে আজও মেয়েদের স্বাধীনতার কোনও দাম দেয় না পুরুষশাসিত সমাজ। কী গ্রামে, কী শহরে।
সম্প্রতি কিরণ রাওয়ের ‘লাপতা লেডিজ’ ছবিটি নিয়ে হইচই হচ্ছে প্রচুর। বহু আলোচিত ‘অ্যানিমাল’-কেও হারিয়ে দিয়েছে ভিউয়ারশিপে। এক কোটি ৩৮ লক্ষ লোক দেখে ফেলেছেন ছবিটা। কাল্পনিক এক রাজ্য নির্মলপ্রদেশে দুই নববিবাহিতা তরুণী স্বামীর সঙ্গে ফিরছিলেন একসঙ্গে। তাঁদের মুখ ছিল ঘুঙ্গটে ঢাকা। ট্রেন থেকে নামার পর এক তরুণী আর এক বরের সঙ্গে বাড়ি চলে গেল। আর এক তরুণী হারিয়েই গেল বড় জংশন স্টেশনে। কাল্পনিক নাম নির্মলপ্রদেশ। বাস্তবে এটা আসলে উত্তরপ্রদেশ হতেই পারে। যে রাজ্যের সাংসদ প্রধানমন্ত্রী মোদি, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার যোগী আদিত্যনাথ। ওই ছবিটি আরও একবার জািনয়ে দেয়, ভারতীয় গ্রামের মেয়েরা এখনও কীভাবে অসহায় পড়ে রয়েছেন।
শেষ বিকেলে হয়তো হিন্দি বলয়ের কোনও গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন আপনি। মাঠ এখন কার্যত ফসলহীন। উত্তরপ্রদেশে গোরু-মহিষ চড়ানোর কাজ করেন পুরুষরা। ছাগল মেষ চড়ানোর কাজটা করেন মেয়েরা। বিকেলে যেতে যেতে আপনি অবধারিত দেখবেন, অন্তত একশো-দেড়শো ছাগল চড়ছে খেতে। তাদের ঘিরে মহিলা, কিশোরী ও শিশু। কিশোরীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটাই তোমার কাজ।
বাংলায় অন্তত এই ধারণার মূলে কুঠার চালানো হয়েছে বহু যুগ হল। একশো পঁচিশ বছর আগে আমাদের বাংলায় এক গৃহবধূ নিজে কিছু করার তাগিদে বেছে নিয়েছিলেন বাঘবন্দি খেলা, যেখানে জীবন ও মরণ ঝুলত এক সুতোয়। আজ এতদিন পরে, এখনও যে সব বঙ্গ মহিলা সবাই যে খুব ভালো আছেন, তা নয়। ভাবাটাই ভুল। এখনও অনেক গ্রামে রয়েছে প্রধানদের দাপট। স্ত্রী প্রধানদের হয়ে কাজ চালান স্বামীরা। অনেক শহরের উপকণ্ঠেও বসে সালিশি সভা বা খাপ পঞ্চায়েত। এখনও রাজ্য মহিলা কমিশনের দ্বারস্থ হন পরিবারে অনেক অত্যাচারিত নারী। তারপরেও নারীদের যা রয়েছে, সেটাই অনেক বড় কথা, অনেক বড় প্রাপ্তি। স্বাধীনতা। চাইলে শেকল খুলে বেরোনোর রাস্তা তাঁদের সামনে। উন্মুক্ত। নারীরা সঠিক পথ জানলে তাঁদের জন্য প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর জেগে থাকে।
হলদিবাড়ি-এনজেপি সকালের ডেমুতে বহু প্রবীণা আসেন শাকসবজি নিয়ে। রবিবারে বিধান মার্কেটের সামনে অন্তত গোটা কুড়ি মহিলা সাপ্তাহিক বাজারে আসেন বাড়িতে তৈরি জিনিস বিক্রি করতে। সেবক রোডের অ্যাক্রোপলিস মলের সামনে প্রতি রবিবার গাড়িতে পাহাড় থেকে মেয়েরা আসেন গ্রামীণ হাটে জিনিস বেচতে। এনবিএসটিসির বাসে প্রচুর মেয়েরা যান বহু দূরে শিক্ষকতা করতে। মালদা, বালুরঘাটে অনেক রাতে মেয়েরা ফেরেন রবীন্দ্র সন্ধ্যার রিহার্সাল সেরে। কলকাতা বা শিলিগুড়িতে অনেক নারী কাকভোরে বেরিয়ে রাতে বাড়ি ফেরেন রুটি েরাজগারের জন্য। ভয়ডরহীন, পরিশ্রমী। আমার ইচ্ছেমতো জীবন বেছে নেওয়ার কারিগর।
এসব দেখেশুনে ভাবি, কয়েক যুগ আগে সুশীলাসুন্দরীর স্বপ্ন স্বার্থক। জীবন এক সার্কাস। মেরা নাম জোকার ছবির রাজ কাপুর-মান্না দে’র যুগলবন্দির গানের মতো–‘পহলা ঘণ্টা বচপন হ্যায়, দুসরা জওয়ানি হ্যায়, তিসরা বুড়াপা হ্যায়।’ সুশীলাসুন্দরীও তো তিন ঘণ্টার শো-তে এমনই স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন। এমন স্বাধীনচেতা হওয়ার। তিনিও এমন স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রথম এমএ পাশ করা বাঙালি চন্দ্রমুখী বসু, প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (বসু)-এর কথা মনে পড়ে। তাঁরাও তো এইরকম উত্তরসূরি চেয়েছিলেন। এমন স্বাধীনতার স্বাদই।