Friday, May 17, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়শতবর্ষে গীতা: মহিলা বিলে প্রথম কণ্ঠ

শতবর্ষে গীতা: মহিলা বিলে প্রথম কণ্ঠ

কেন্দ্রে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন গীতা মুখোপাধ্যায়। একটি শাড়িতেই অনেক দিন চলত এই বিখ্যাত নেত্রীর

  • সাহানা নাগ চৌধুরী

ভারতের রাজনীতিতে প্রয়াত গীতা মুখোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল তারকা। সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংসদের মধ্যে দাঁড়িয়ে অথবা বাইরে তাঁর দীর্ঘ লড়াই জনগণের কাছে আজও দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি আজীবন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) দলের সদস্য ছিলেন। এই বাংলাকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসাবে। বাংলা ঘিরেই ছিল তাঁর যাবতীয় স্বপ্ন।

এই ব্যক্তিত্বময়ী দীর্ঘজীবনের সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের শতবর্ষ উত্তীর্ণ আজ, সোমবারই। ১৯২৪ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের যশোহর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মসূত্রে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের কন্যা হলেও শেষপর্যন্ত কমিউনিস্ট দলের প্রতিই তিনি আকৃষ্ট হন কীভাবে, সেটাও এক আশ্চর্য কাহিনী।

বিয়ের আগে তাঁর পরিবার ছিল সমাজের এক বিত্তশালী, ধনী পরিবার। এই রায়চৌধুরী পরিবারের কর্তা তাঁর বাবা ব্রিটিশ সরকারের থেকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবও পান। এহেন পরিবারের মেয়ে গীতা রায়চৌধুরী ছাত্রী অবস্থাতেই যোগ দেন ‘বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (বিপিএসএফ)-এ। সেখানে যোগ দিয়ে তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দিদের মুক্তির দাবিতে যে আন্দোলন চলছিল তাতে যোগ দেন। এই আন্দোলনের প্রেরণা পেয়েছিলেন বিপ্লবী কল্পনা দত্তর থেকে। এরপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। আশুতোষ কলেজ থেকে বাংলায় বিএ পাশ করেন ১৯৪২ সালে। এরপরেই তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে সিপিআইয়ের অন্যতম নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের আলাপ। ও পরে তাঁরা বিয়ে করেন। ১৯৪৫ সালে গীতার নেতৃত্বে ডাক বিভাগের কর্মীদের বঞ্চনার প্রতিবাদে এক আন্দোলন হয়। তখন তিনি ছাত্রীই ছিলেন।

১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দেশে নিষিদ্ধ হয়। তখন গীতা ও বিশ্বনাথ দুজনেই বিনা বিচারে দীর্ঘদিন প্রেসিডেন্সি জেলে থাকেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গীতা পুরোপুরিই ছাত্র সংগঠনের মুখ হয়ে ওঠেন।

ইতিমধ্যে ভারতের কমিউনিস্ট দলে আসে বিশাল পরিবর্তন। ১৯৬৪ সালে বিভিন্ন মতাদর্শের কারণে পার্টি ভাগ হয়। গীতা আজীবন সিপিআই দলেই থাকেন। সিপিএম দলে তিনি যোগ দেননি। বরং মেদিনীপুর জেলার তমলুক কেন্দ্র থেকে ১৯৬৭ এবং ১৯৭২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। এরপর ১৯৭৮ সালে তিনি ওই মেদিনীপুর জেলারই পাঁশকুড়া কেন্দ্র থেকে লোকসভা ভোটে জেতেন। এবং আমুত্যু ওই লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন।

গীতা সিপিআইয়ের ন্যাশনাল কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮১ সালে ন্যাশনাল এগজিকিউটিভ হন। তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মহিলা সেক্রেটারিয়েট ছিলেন। এবং জাতীয় মহিলা ফেডারেশনের ১৯৬৫ সাল থেকে একজন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও জাতীয় মহিলা কমিশন, জাতীয় গ্রামীণ কমিশন এমনকি প্রেস কাউন্সিলেরও একজন সদস্য হন।

এই গুরুত্বপূর্ণ সাংসদ এত কাজের মধ্যে থাকলেও নিয়মিত বাংলার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতেন। ফলে এই মহীরুহসম ব্যক্তিত্ব বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত পরিচিত ও কাছের মানুষ হিসাবেই সমাদৃত ছিলেন।

এহেন আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্বটির সঙ্গে কাজের সূত্র ধরেই আলাপ ১৯৮৪ সালের পাঁশকুড়া কেন্দ্রের লোকসভা নির্বাচন কভার করার সময়।

অফিস থেকে আমাকে এবং আমার কনিষ্ঠা ভগিনীসম এক সাংবাদিককে পাঠানো হল তাঁর উপর খবর করতে। সেই প্রথম আমাদের দুজনের কলকাতার বাইরে গিয়ে রিপোর্ট করার উত্তেজনা এবং নির্বাচনকেন্দ্র পরিক্রমা। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

চারদিক থেকে শয়ে-শয়ে সাধারণ মানুষ আসছে। ধামসা, মাদল বাজাতে বাজাতে ছোট শিশুকে কোলে কাঁধে নিয়ে মেয়েরাও যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনও মেলা প্রাঙ্গণ। এইসময় ধুলোর ঝড় তুলে সাংসদের গাড়ি এসে থামল মঞ্চের খুব কাছেই। গীতা গাড়ি থেকে নামলেন। নেমেই মঞ্চে না উঠে সোজা আমাদের কাছে এলেন। এসেই জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাংলার মেয়েরা বাংলা কাগজের সাংবাদিকতা করছে দেখে খুব খুশি হলাম।’ সেই শুরু, তারপর থেকে গীতার সঙ্গে তৈরি হয়েছিল এক অন্য ধরনের সম্পর্ক।

ঘটনাচক্রে শৈশব থেকে আমরা ছিলাম ওঁর এক ভাশুর অর্থাৎ বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের এক দাদা ডাঃ সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। ফলে মেদিনীপুরের ওই মুখোপাধ্যায় বাড়ির বেশ কিছু সদস্য ছিলেন আমাদের আত্মীয়। একসময় দেখা গেল, এক ভাইফোঁটায় ওই বাড়িতে চাঁদের হাট। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় সহ আরও অনেকেই উপস্থিত। আছেন গীতাও।

তবে মানুষটি যে একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন সে ব্যাপারে এখনও স্মরণ করেন শ্যামশ্রী দাস। শ্যামশ্রী বর্তমানে সিপিআই দলের মহিলা সমিতির সচিব। নিজেই বললেন, ‘দিদিই আমাকে তৈরি করেছেন, তাঁকে এত কাছ থেকে দেখেছি যা ভোলা যাবে না সহজে।’ তাঁর কথাতেই জানতে পারি, তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সহজ, সরল। নিজের জীবনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই ব্যবহার করতেন না। এমনকি সকালে যে শাড়ি পরতেন, সেটি রাতে এসে বদলে পরের দিন নিজের হাতেই ধুতেন। পরে নিজেই ইস্ত্রি করে ফেলতেন। সারাদিন পার্লামেন্টে থেকে সব বিতর্কে যোগ দিয়ে বাড়িতে ফিরেই পরের দিনের জন্য প্রস্তুত হতেন।

গীতার জীবন ছিল বহু বর্ণময়। সম্পর্কে তাঁর নাতনি শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতি তুলে আনেন বহু কথায়, যাতে গীতাকে এক অন্য পরিচয়ে ধরা যায়। তিনি মুখে মুখে প্রচুর ছোটদের গল্প বলতেন। সেইসব গল্প পরে বই আকারেও বেরিয়েছে।

এই যে মহিলা বিল নিয়ে এত লেখালেখি, হইচই, সে ব্যাপারে প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন গীতাই। তিনি তখন সংসদে মহিলা বিল বিতর্ক নিয়ে প্রবল সরব। সংসদে বারবার বিভিন্ন সরকারের সামনে তাঁর এই বক্তব্য রাখছেন। ১৯৯৬ সালে আইকে গুজরালের মন্ত্রিত্বের প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ আজীবন মেয়েদের বিভিন্ন আন্দোলনের কান্ডারি হয়ে তিনি যে সংসদ থেকে এই বিল আইন হিসেবে পাশ করাতে পারছিলেন না, তাতে মানসিকভাবে খুবই আঘাত পান। ফিরে আসি শ্যামশ্রীর কথায়। তিনি বলছিলেন, ‘২০০০ সালে দিদি চলে গেলেন। তার আগে তিনি বারবার বলতেন, ‘কী রেখে যাচ্ছি আমাদের মেয়েদের সামনে? কী রেখে যাব এই অত্যাচারিত, নিপীড়িতদের কাছে? যদি এই বিল পাশ না হয়, তাহলে এটা আমাদের দেশের লজ্জা।’

তাঁর মৃত্যুর ২৩ বছর পর সেই বিল সংসদে পাশ হয়েছে ঠিকই, তবে তার উপর যে কাঁচি চালানো হল, তা যে তাঁকে দেখতে হল না, এটাই বাঁচোয়া। না হলে তাঁর শতবর্ষে আমাদেরও মুখ দেখানোর কোনও জায়গা থাকত না। এক আকাশচুম্বী রাজনৈতিক নেতা, নিজের আদর্শকে ঋজু রেখে, দীর্ঘদিনের সাংসদ পদটির পুরো মর্যাদা দিয়ে আজকের এই ঘুণধরা সমাজের সামনে যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন, তাতে বাংলারই মুখ উজ্জ্বল হয়েছে।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Sex Worker | ঘরের বৌকে যৌনকর্মী হতে চাপ! কাঠগড়ায় স্বামী-শাশুড়ি

0
শিলিগুড়ি: সন্তান জন্মের পর থেকেই বাড়ির বৌকে যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন খোদ স্বামী ও শাশুড়ি। আর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে শোরগোল পড়ে...

Siliguri | গৃহবধূকে দুই মেয়ে সহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ শাশুড়ির বিরুদ্ধে

0
শিলিগুড়ি: স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই গৃহবধূকে অত্যাচারের অভিযোগ শাশুড়ি ও ননদের বিরুদ্ধে। দুই কন্যা সন্তান সহ তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠল...

Manikchak | তৃণমূল অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ, কাঠগড়ায় কংগ্রেস

0
মানিকচক: তৃণমূল (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে প্রাণে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠল কংগ্রেসের (Congress) বিরুদ্ধে। মালদার মানিকচকের (Manikchak) গোপালপুরের ঘটনা। জানা গিয়েছে, দলীয় কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন...

Mamata Banerjee | সিপিএমের সঙ্গে নন্দীগ্রামে গণহত্যা ঘটিয়েছিলেন শুভেন্দু-শিশির! নাম না করেই বিস্ফোরক ইঙ্গিত...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক : নন্দীগ্রাম গণহত্যা নিয়ে ফের বিস্ফোরক মমতা। এবার নাম না করে নন্দীগ্রাম গণহত্যার দায় চাপালেন অধিকারী পরিবারের উপরে। বৃহস্পতিবার পূর্ব...

Malda news | নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

0
মালদা: নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষীর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করল মালদা জেলা আদালত। এছাড়া এক লক্ষ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের...

Most Popular