সরোজ উপাধ্যায়
ভারতের সঙ্গে ইজরায়েল সরকার ২০২৩ সালে একটি চুক্তি করেছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ভারত থেকে ৩৪ হাজার নির্মাণশ্রমিক ও ৮ হাজার নার্সিং কর্মী আনা হবে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইজরায়েল ৮০ হাজার প্যালেস্তাইন শ্রমিকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর শ্রমিকের অভাব দেখা যায়। এই অভাব মেটাতে ভারত থেকে তড়িঘড়ি শ্রমিক আনার ব্যবস্থা হল। এবং ভারত থেকে প্রথম দলটি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সে দেশে পৌঁছে গিয়েছে। ভারত থেকে দ্রুত ৬০০০ শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার কথা চলছে।
আমরা বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা বলি। এই সমস্যা সব রাজ্যেই। শ্রমিকরা যেভাবে যুদ্ধবিপর্যস্ত দেশে চলে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছেন, তাতে তাঁদের মরিয়া ভাব প্রমাণ করে। বোঝা যায়, দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের অভাব। এই শ্রমিকদের অনেকেই বলেছেন দেশে তাঁদের জন্য কোনও নিয়মিত কাজ নেই। উলটোদিকে ইজরায়েলে বেতনের হার অনেকগুণ বেশি। তাঁদের কথাগুলো হৃদয় স্পর্শ করে। তাঁরা বলেন, যুদ্ধ হলেও আমাদের যেতেই হবে।
২০২৩ সালের মে মাসে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি যে হিসেব দিয়েছিল, তাতে একটা তথ্য স্পষ্ট। ভারতে বেকারত্বের হার বেড়েই চলছিল। ওই সময়ে দেশের শ্রমিক সংখ্যার ৭.৮ শতাংশ ছিল বেকারত্বের কবলে। ওই সমীক্ষায় আরও জানা যায়, দেশে উচ্চমান সম্পন্ন কাজের নিতান্ত অভাব।
গত দশ বছরে ভারতীয় অর্থনীতি (করোনার বছরগুলো বাদ দিলে) প্রায় ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি ভারতকে বিশ্বের পাঁচ নম্বর বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। কিন্তু এই বৃদ্ধি ভারতের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়নি, কারণ ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন শিল্পে বৃদ্ধির হার ছিল অপ্রতুল। পরিষেবা ক্ষেত্রের উৎপাদন যদিও বেড়েছে, কিন্তু তা ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তিকে সামগ্রিকভাবে নিয়োজিত করতে পারেনি। এই অবস্থাটকে অর্থনীতির ভাষায় জবলেস গ্রোথ বলা হয়। বাংলায় বললে কর্মহীন প্রবৃদ্ধি।
গত ৮ বছরে বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি প্রচলন, করোনা সংক্রমণের প্রভাবে অসংগঠিত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। এছাড়াও স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, মেক ইন ইন্ডিয়া সমেত বিভিন্ন স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চেষ্টা সফল হয়নি ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়নের ফলে।
এই জবলেস গ্রোথ থেকে বেরোতে গেলে কী করা উচিত? প্রথমত, শ্রমনিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। ১০০ দিনের কাজের মতো কর্মসূচিকে আরও ব্যাপক করতে হবে। জিএসটি সরলীকরণ, শ্রম নিবিড় পণ্যের নির্মাণ, সম্প্রসারণ এবং একটি তেজি বাজার ব্যবস্থার উদ্ভাবন জরুরি। সরকারি স্তরে অনেক বেশি টাকা সংস্থান করা দরকার। কর্মসংস্থান কাজে বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে স্বনিযুক্তি প্রকল্প, স্টার্টআপ উদ্যোগ যাতে ভালো হয়, তার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ভোটের ফল যাই হোক, দেশে কর্মহীনতা জনমানসে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে আনা খুব জরুরি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রাণের ভয় উপেক্ষা করে আমাদের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে, এটা খুব ভালো লক্ষণ নয় মোটেই।
(লেখক অর্থনীতির শিক্ষক। সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়)