শিমূল সরকার
বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। দেশের কবির এই উক্তির পাশে সাহেব কবির কথাতে, শীত এলে বসন্ত কি খুব পিছনে থাকতে পারে! বসন্তকালের আয়ু কমছে। শীত শেষ হলেই এখন ঝপ করে গরমকাল শুরু হয়।
বসন্তকাল আবেগপ্রবণ বাঙালির আয়েশ করার সময়। কথায় বলে, বাঙালির আঠারো মাসে বছর। বসন্তকালে আলস্য বেড়ে যায়। এখন চলতি কথায় ল্যাদ খাওয়ার ঋতু। কাগজে-কলমে ফাল্গুন-চৈত্র দু’মাস হলেও আদতে টেনেটুনে চার হপ্তার বেশি দক্ষিণবঙ্গে টেকে না। উত্তরবঙ্গে বনভূমি বেশি থাকার জন্য একটু দীর্ঘ তার আয়ু। বসন্তের উত্তর আলাদা এক আমেজ আনে!
উত্তরে বসন্তের উপস্থিতি বেশ প্রকট। গাছে গাছে নতুন হালকা কচি পাতার বাহার চোখ জুড়িয়ে দেয়। পাখিদের ডাকার পরিমাণ যেমন বেড়ে যায়, তেমনই তাদের দেখাও মেলে প্রচুর। সকাল থেকে বসে থাকলে মাদারিহাটে ফুলভর্তি শিমুল গাছে তাদের ওড়াউড়ি। প্রভাত থেকে দিনভর বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। সেলিম আলিকে বড্ড মনে পড়ে। কোকিলের ডাক শুনে, কোলে থাকা এক বাচ্চা গত বছর দেখলাম বায়না ধরেছে। বাবা ওই বাঁশিটা দাও!
দক্ষিণবঙ্গে বড় শহরে দু’-চারটে কোকিল মাঝেমধ্যে ডেকে নিজেরাই বোধহয় লজ্জা পেয়ে চুপ করে যায়। প্রেমিকা কোকিলকে ডাকলেই বিপদ! সংসার পাতায় উন্নতির দাস মানুষ বিস্তর ঝামেলা পাকিয়ে রেখেছে। ডিম পারবে কার বাসায়! কাকই তো আজ বিরল। তাদের ঘর করার জায়গা নেই। গাছের মাথায় ঘর বাঁধতে হলে কলকাতা ছেড়ে মফসসলে পাড়ি দিতে হবে। বসন্তের পাখিরা আজ সকলেই প্রায় পঞ্চায়েতের অধীনে।
উত্তরবঙ্গে সেই ঝামেলা কম। কোকিল, পিউ কাঁহারা এখনও স্বছন্দে ডেকে ওঠে। বসন্তবৌরি, বৌ কথা কও, দোয়েল কত চরিত্র! নির্জন দুপুরে চাতক পাখির ফটিক জল আত্মকান্না মনকে আলুলায়িত আবেগপ্রবণ করে। আলস্য ভূতের মতো চেপে ধরে। চোখের চাহনি নীল আকাশে আটকে থাকে। সংসারের চাপ না থাকলে অফিসের রেজিস্টারে দু’-চারটে কবিতা ফুটে ওঠাও বিচিত্র নয়।
কত ধরনের ফুলে যে প্রকৃতি সেজে ওঠে তার ইয়ত্তা নেই। পশ্চিমের পুরুলিয়া-বীরভূমের মতো পলাশের আগুন খেলা না হলেও শিমুলও কম যায় না। লাল হয়ে থাকে গাছের নীচে। সেখানে নিশুতি রাতে জলদাপাড়া থেকে খটখট আওয়াজ তুলে হরিণের দল দৌড়ে আসে শিমুল ফুল খেতে। বাইসন-হাতিতেও নাকি মুখ লাগায়। মহুয়ায় মধু জমেই। ভালুকের দল অযোধ্যা পাহাড়ে আসে নেশা করতে। উত্তরের ভালুকের সেই নেশার টান অতটা প্রকট নয়।
ভৌগোলিক দূরত্ব কলকাতা থেকে সর্বনিম্ন তিনশো ও সর্বোচ্চ ৭৫০ কিলোমিটার। যাঁরা দক্ষিণকে এগিয়ে রাখেন তাঁরা বসন্তে উত্তরে এসে দেখুন। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করলে প্রকৃতি নিজেকে ঢেলে সাজিয়ে রাখে। প্রকৃতির আশীর্বাদে উত্তরের থেকে দক্ষিণ কয়েক যোজন পিছনে। নিন্দুকেরা বলবেন, পেশার নিরিখে উত্তরকে দক্ষিণবঙ্গ টেক্কা দিচ্ছে। এই সাতশো কিলোমিটার দূরত্ব কিন্তু উন্নত দেশে মাত্র ছয় ঘণ্টার। পরিকাঠামোর জন্য সেই যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের হাতে নেই। নিত্যযাতায়াতে পাঁচশো কিলোমিটার খুব বড় দূরত্ব নয়। পরিকাঠামো ও গতি বাড়লে একদিনেই যাতায়াত সম্ভব।
তাছাড়া শুধুমাত্র উপার্জনের উপর নাগরিকদের সুখ নির্ভর করে না। মহাজনেরা বলে গিয়েছেন, সুখ টাকা দিয়ে মাপা যায় না।
শহুরে গরমে কয়েকদিন পরে দক্ষিণের মানুষ বাতানুকূল যন্ত্রে কৃত্রিম আবহাওয়াতে দূষণ ছড়িয়ে তৃপ্ত হবেন। উত্তরে হিমালয়ের প্রাকৃতিক হিমেল হাওয়াতে ঝড়ু কুজুরের টিনের ঘরে শান্তির ঘুম নামবে। মনে রাখতে হবে প্রকৃতিই শেষ কথা।
(লেখক পুলিশ অফিসার। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন উত্তরবঙ্গে)