- সুদেষ্ণা মৈত্র
আমরা যারা বড়দিনপিয়াসী তারা কেকের বিলাসে এক উচ্ছ্বল রোদ্দুরের সকালের অপেক্ষায় থাকি। উত্তরবঙ্গের কার্নিভালের দম ফাটানো চিৎকার আর রাতারাতি পরিষ্কার রাস্তার চোখধাঁধানো আলো আমাদের ভাবায় উৎসব, সান্তাক্লজ, মোমবাতি আর জিঙ্গল বেল আমাদের বড়দিন চেনায়। অথবা চা বাগান বা সাঁওতাল গ্রামের চার্চের প্রার্থনা।
আমরা গাজোল, হবিবপুর, বামনগোলার ওই মানুষদের ‘ওরা’ বলে জানি। বাংলার ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া মানুষগুলো বাংলা ভাষায় কথা বললেও তারা ‘সাঁওতাল’ হিসেবেই ভাবা হয় আমাদের মস্তিষ্কের অভিধানে। আমরা কখনও জানতে চাইনি কতগুলো উপজাতি মিলে রয়েছে এই একসারিতে সাজানো ‘ওদের’ ভিতর। আমরা কী করব তাঁদের খ্রিস্টান ধর্মের অনুরক্তি দেখে? মালবাজারের চা বাগান বা গাজোলের রুক্ষ প্রান্তর, সর্বত্র এক ছবি। বড়দিন এলেই আমরা বাকিরা ওঁদের কথা ভাবতে শুরু করি।
খ্রিস্টান মানে আমাদের কাছে সাদা চামড়ার রাজনীতি, অন্য দেশের বিষয়, অন্য দেশের মানুষ। মুন্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতালদের লড়াই, জঙ্গল হারানোর দুঃখ, খ্রিস্টান ধর্মের সেবা আমাদের কাছে চরম উন্নাসিকতার বিষয়। আমরা কোনওদিন ভাবিনি উত্তরবঙ্গের চা বাগানে, গৌড়বঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলে কত খ্রিস্টান থাকেন। তাঁরা কীভাবে থাকেন, তাঁদের প্রধান সমস্যা কী। তাঁরাও যে বাঙালি, সেটা মানতে বা ভাবতে আমাদের অনেকের আপত্তি। ভোটের সময় তাঁদের কথা মনে পড়ে। তবু খুব অল্পভাবে। কিছু কিছু আসনে। অন্যান্য সম্প্রদায়ে ভোট পাওয়ার জন্য বাংলায় নেতাদের যা আকুতি, তা খ্রিস্টানদের জন্য দেখা যায় না। তাঁদের জন্য আমাদের সব ভাবনা আসে ক্রিসমাসের সময়। তারপর আমরা তাঁদের একেবারে ভুলে যাই।
আমরা কোনওদিন স্টিফান হোরোদের আপন করতে পারিনি। আমরা যারা কখনও মানতে চাইনি চিরকি বেসরাদের বাঙালি বলে, তারা একমাত্র ২৫ ডিসেম্বর চার্চের মাঠে নাচ ছাড়া কোনও অস্তিত্ব রাখতে অক্ষম উত্তরবঙ্গের মানুষের সাহেবিয়ানার চোখে। আমরা বরং খ্রিস্টান বাঙালি অনেক সহজে মেনে নিতে ও মনে নিতে রাজি, তবে বাঙালি খ্রিস্টান নয়। গাজোলের জনজাতি এখনও আমাদের চোখে কষ্টিপাথরের গড়ন, হাতে তিরধনুক। তাই ডিএম অফিস জমি যখন ঘেরাও হয়, হারানোর বিচার চেযে যখন রোগা পেলব শরীরে আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলতে দেখি আমারই বন্ধু তুফানি মুদিকে, তখন আমাদের রোমান্টিক কল্পনায় আঘাত লাগে।
আমরা আরও একধাপ নীচে নামিয়ে ফেলি তাদের। হবিবপুরের ধানের গোলা, শস্যের সাজ, সূর্যাস্ত আমাদের যেভাবে টানে, ঠিক ততোধিক তুচ্ছতায় দেখি সেখানে বাস করা আদিবাসীদের, যাঁরা নিজের ধর্ম হারিয়ে ভাষা হারিয়ে আমাদেরই অপরাধে খুঁজে নিয়েছেন অন্য ধর্মে আশ্রয়। সেই ধর্মের প্রতি আমাদের অনুগত রোমান্টিকতার সম্মানে সেইসব বাঙালি খ্রিস্টানদের খ্রিস্টান হিসেবে মানতে আমরা হাসব বইকি!
- (লেখক সাহিত্যিক। মালদার বাসিন্দা)