- যশোধরা রায়চৌধুরী
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে কৃত্তিবাসীদের স্বীকারোক্তি মূলক কবিতা শাসিত পরিসরে সদ্য প্রয়াত দেবারতি মিত্রের আবির্ভাব। যৌনতার নারীকেন্দ্রিক বয়ান নির্মাণে এই মগ্ন ও অন্যথায় লিঙ্গ-নির্বিশেষ ও প্রশমিত শব্দ ব্যবহারের কবি অদ্ভুত এক স্বতঃস্ফূর্ততা রেখেছিলেন। যাকে অশ্লীল বলা চলেই না। চিত্রকল্পের আশ্চর্য কৃতিতে তাঁর রচনায় রতিক্রিয়া একটি দিব্যবিভা প্রাপ্ত হয়। ‘প্রিয়তম পুরুষটি এক পা একটুখানি উঁচু করে’…দিয়ে শুরু হয় কবিতা, এবং কিছু পরে ‘সুকুমার ডৌলভরা মাংসল ব্রোঞ্জের উরু’ ‘হঠাৎ সচল হয়ে ডাকে তরুণীকে’-এই বর্ণনা আমাদের স্তম্ভিত করে। এবং মনে হয় পৃথিবী যেন পুনরাবিষ্কৃত হল। এরপরেও আর কোনও লেখায় সম্ভব হল না এমন বর্ণনা : যেখানে মেয়েটি ‘অসম্ভব অনুরক্তা শিশুসুলভতা নিয়ে/ অচেনা আশ্চর্য এক লালচে কিসমিসরঙা/ ফুলের কোরক মুখে টপ করে পোরে, / মাতৃদুধের মতো স্বাদু রস টানে/ ক্রমে তার মুখে আসে/ ঈষদচ্ছ অনতিশীতোষ্ণ গলা মোম/ টুপটাপ মুখের গহ্বরে ঝরে পড়ে/ পেলিকান পাখিদের সদ্যোজাত ডিম ভেঙে জমাট কুসুম নয়/ একটু আঁশটে নোনতা স্বচ্ছ সাদা জেলি’ (পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী তারা দুজন)।
এই চিত্ররূপময় বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে কেন, বিশ্ব সাহিত্যেই দুর্লভ বলে মনে হয়। অথবা ‘পদ্মগোখরোর শিস’ এতটাই স্পষ্ট ও সবাক রতিকবিতা, যে ভুল করে যৌনতার কবিতা ভেবে ফেলার নয়। এই পবিত্রতা এই বিশুদ্ধতা নিয়ে যৌনতাকে কোনও কবিতায় সাধন করতে কোনও কবিকে বাংলা ভাষায় আজ পর্যন্ত দেখিনি এবং রূপের রসের বিশুদ্ধতায় দেবারতি মিত্র নমস্য। সে অর্থে তাঁকে বাদ দিয়ে কোনও নারীকেন্দ্রিক রতিকবিতার সংকলন হয় না। রতিসৌন্দর্য তিনি যে দক্ষতায় বা অবলীলতায় লেখেন তা কোনও পুরুষ কবির পক্ষেও প্রায় অসাধ্য, এবং এই সৌন্দর্য নির্মিতির জন্যই মাইকেল অ্যাঞ্জেলো বা বের্নিনিদের কাছাকাছি শিল্পবস্তুটি হাসিল করে ফেলেছেন দেবারতি। যা এই বইয়ের অন্যতম সম্পদ, সংকলিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমার পুতুল’ এর কবিতা দু-তিনটি।
দেবারতির কবিতা পড়তে পড়তে যে ভ্রমণটা হয়ে থাকে, তা একেবারেই অনন্য স্বাদের ভ্রমণ। দূর থেকে দূরতর স্থানে তিনি নিয়ে যান আমাদের। একইসঙ্গে তিনি যুক্ত করেন ও যুক্ত থাকেন বিবিধ কবিতার ভাষাসাজের ঐতিহ্যের সঙ্গে। একটি সার্থক কবিতা পাঠ আসলে পাঠকেরও দায়িত্ব বাড়ায়, তাকে মুহুর্মুহু জুড়ে দিতে থাকা নানা উল্লেখের জালে। এই নানা পড়ার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার খেলাটা যে কোনও ভালো কবিতাই আমাদের দেয়, এক্ষেত্রেও তিনি দেন।
যেমন, যখন লিখছেন, ‘তুমি কিছু না ভেবে সব আরম্ভ করে দাও, তুমি কিছু না ভেবেই সব শেষ করো।/হারমোনিয়াম তা পারে না, কেননা,/গহন বনের কাঠ থেকে তাকে আস্তে আস্তে তৈরি হতে হয়েছিল…
অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায়, ফরাসি কবিতার ঈশ্বর র্যাঁবো তাঁর শিক্ষক ইজামবারকে একটি বিখ্যাত চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি হলাম অন্য কেউ। কী দুরবস্থা সেই কাঠের টুকরোর, যে হঠাৎ দেখে, সে হয়ে উঠেছে বেহালা।’
এক আশ্চর্য মাতৃতন্ত্রের, নারীপ্রবাহের নাড়িতে বাঁধা ছিলাম। সে নাড়ির টান তো ভোলার নয়। যখনই কোনও কবি চলে যান, রাজলক্ষ্মী কবিতা, নবনীতা, বিজয়া, মল্লিকা অথবা পৌলোমী, সেই নাড়িতে টান পড়ে। আজ ঘুরেফিরে দেবারতির অন্তর্ধানে সেই বেদনা ফিরে আসে, আত্মজন হারানোর।
(লেখক সাহিত্যিক)