- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
পিটি উষা সেদিন কিছু একটা বলেছিলেন প্রেসকে। সেটা অবশ্যই বিতর্কিত। নয়াদিল্লির ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থার অফিসে প্রকাশ্যেই ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যাথলিটকে ধমক দিয়ে উঠেছিলেন অজয় প্যাটেল। ‘এত কথা বলার কী ছিল?’
ঊষা অলিম্পিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট। প্যাটেল সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট। আপনি বিস্মিত হতে পারেন, কিন্তু এসে যায় না। উষাকে ধমক দেওয়ার অধিকার ভদ্রলোকের রয়েছে অবশ্যই! তিনি অমিত শা’র অত্যন্ত কাছের লোক। নামী শিল্পপতি। গুজরাট রাজ্য কোঅপারেটিভ ব্যাংক এবং আহমেদাবাদ জেলা কোঅপারেটিভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান। গুজরাট চেম্বার অফ কমার্সের চেয়ারম্যান। রাজধানীতে খেলার সঙ্গে যুক্ত লোকেরা জানেন, এই ভদ্রলোকই আসলে আইওএ’র ওয়াচম্যান। জাতীয় শুটিংয়ে আছেন, দাবাতেও। এই গুজরাটি শিল্পপতির কাছে উষার অপমানিত হওয়ার গল্প রাজধানীর ক্রীড়ামহলে প্রচলিত। লাইনগুলো লিখতে গিয়ে বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রেস ক্লাবে আর এক সর্বকালের সেরা মেয়ে খেলোয়াড় সাক্ষী মালিকের কান্নার ছবি চোখে ভাসে। সাক্ষী খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন জাতীয় কুস্তি সংস্থার নির্বাচনে চরম বিতর্কিত ব্রিজভূষণের ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় সিং প্রেসিডেন্ট হওয়ায়।
ঘটনাটার দুটো দিক আছে। যা মারাত্মক ভয়ংকর ভারতের খেলার ক্ষেত্রে। ভারতীয় খেলার দুর্দশার প্রতীক। প্রতিবাদ করার শাস্তি কী, তা দেখানো হল সাক্ষীদের। এক, ভোটে সরকারের মনোনীত প্রার্থী কুস্তিগির অনীতা সেওরাম প্রেসিডেন্ট পদে ৭-৪২, বিধ্বস্ত সঞ্জয়ের কাছে। কী অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার। অন্য সব পদে সরকারের লোক জিতলেন। শুধু প্রেসিডেন্ট পদে ব্রিজভূষণের খাস লোক। ডাল মে কুছ কালা…না না…ডাল মে বহুত কালা হ্যায়।
দুই, সাক্ষী খেলা ছাড়ার কথা ঘোষণার পরে নামী ক্রীড়াবিদরা অধিকাংশই চুপ। কেউই সাক্ষীর হয়ে সরব হতে চাইলেন না তাঁরা। কেন? আসলে বুঝে গিয়েছেন সাক্ষীর জন্য, সাক্ষীদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। সব দলের নেতারাও চুপ। কেননা তাঁদের কেউ না কেউ কোথাও কোনও খেলায় ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। সরকার না চাইলে আজ আর কেউ ক্রীড়া সংস্থার মাথায় বসতে পারবেন না, এটা এখন পরিষ্কার। ঠিক এভাবেই ক্রিকেটের সিংহাসনে জয় শা, ফুটবলে কল্যাণ চৌবে, হকিতে দিলীপ তিরকে। খেলোয়াড়দের বসানোটা আইওয়াশ, সব রাজনৈতিক যোগাযোগ। বিজেপি নেতা কল্যাণের বিরুদ্ধে বাইচুংকে হারাতে সে সময় ক্রীড়ামন্ত্রী কিরেন রিজিজু নেমে পড়েছিলেন সদলে। ভোটে কল্যাণ ৩৩-১ ভোটে হারান বাইচুংকে। সেই অঙ্ক মাথায় রাখলে স্পষ্ট, কুস্তিতে ক্রস ভোটিং করে জেতানো হয়েছে বিজেপি সাংসদের ঘনিষ্ঠকে। অবিশ্বাস্য ক্রস ভোটিং। যার শিকার কমনওয়েলথ গেমসে সোনাজয়ী অনীতা। খেলার প্রশাসনে এমন ক্রস ভোটিংয়ের জুয়াচুরি জীবনে দেখিনি। এই গল্পটা মনে করাবে হিরণ্যকশিপু নাটকীয় হত্যা। তাঁকে বর দেওয়া হয়েছিল মানব, দেব, পশু কেউই মারতে পারবে না। সকালে বা রাতে, ঘরের ভেতরে বা বাইরে, পৃথিবীতে বা বাতাসে মৃত্যু হবে না। অত্যাচারী হিরণ্যকশিপুকে নৃসিংহ মারেন অর্ধমানব, অর্ধপশুর রূপ ধরে। দিনরাতের মাঝামাঝি সময়ে। একেবারে জংঘার উপরে রেখে। কেন্দ্রের ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর সেই স্টাইলেই বধ করলেন কুস্তিগিরদের স্বপ্ন। ঠাকুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচনে ব্রিজভূষণ বা তাঁর কোনও ছেলে, জামাই বা আত্মীয়কে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড় করাবে না সরকার। বেশ ভালো। তিনি তো আর বলেননি, ব্রিজভূষণের বহুদিনের সঙ্গীকে দাঁড় করাবেন না। তাই দাঁড় করানো হল মহাবিতর্কিত কর্তার দীর্ঘদিনের অনুগত সঞ্জয়কে। বারাণসীর সঞ্জয় ১২ বছর ধরে কুস্তির প্রধান কাউন্সিলে, চার বছর ধরে যুগ্মসচিব। ব্রিজের সব কুকর্মের সাক্ষী। অনুরাগরা কী ভাবেন, লোকে এত বোকা? কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এটা একেবারে স্পষ্ট গটআপ। যা অমার্জনীয় অপরাধ। কুৎসিত উদাহরণ। সরকারি প্যানেলের বাকি সবাই জিতলেন, আর প্রেসিডেন্ট হেরে গেলেন বড় ব্যবধানে-এ কখনও হয়? অনুরাগদের সাজানো চিত্রনাট্য না হলে? কর্তারা একজোট হয়ে কলঙ্কিত নেতার লোককে ভেট দিয়ে বোঝালেন, যৌন কেলেঙ্কারিতে কিছু এসে যায় না তাঁদের। জানতে চাইবেন, কে প্রতিবাদ করবে তা হলে? খেলোয়াড়রা? না। কুস্তিগিররা পথে নামার সময় নীরজ চোপড়া, অভিনব বিন্দ্রা, সুনীল ছেত্রী, বিজেন্দর সিং, অনিল কুম্বলে, হরভজন সিংরা বিবৃতি দেন তাঁদের হয়ে। সাক্ষীরা পদক বিসর্জন দিতে যাচ্ছিলেন গঙ্গায়। তাতেও দেশের বাকি সুপারস্টাররা মাখা ঘামাননি। অনেক পরে কপিলের উদ্যোগে ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ীরা একটি যৌথ বিবৃতি দেন। পরের দিনই বিনির ডিগবাজি, আমি এ সবে নেই। জানতাম না। বোধহয় বাবা-ছেলের ধমক খেয়েছিলেন।
খেলোয়াড় বা কর্তারা গণহারে প্রতিবাদ করবেন না। মানুষও কি করবে? না এবং না। নইলে এত কেলেঙ্কারির নায়ক, ব্রিজভূষণ শরণ সিং উত্তরপ্রদেশের কাইজারগঞ্জ থেকে ছয়বার লোকসভায় জেতেন কী করে? স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন, বিজেপি কীসের মোহে এরকম দুর্নীতিপরায়ণ লোককে মেনে নিল? দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়ার এত প্রতিশ্রুতি দিয়েও। ঘোড়ায় হাসবে ব্রিজভূষণের দলবদলের অতীত শুনলে। প্রথমে ছিলেন বিজেপিতে। সেখান থেকে দু’বার এমপি। বিজেপি সাসপেন্ড করলে তিনি চলে যান সমাজবাদী পার্টিতে। সেবারও এমপি। ‘দুর্নীতিমুক্ত’ বিজেপি আবার তাঁকে ফিরিয়ে নেয়। ভারতীয় খেলচক্রের রাজনীতিকরণ আজ ভয়াবহ জায়গায়।
প্রিয় পাঠক, পশ্চিমবঙ্গের অতি ম্লান খেলার বৃত্তটা ভাবুন। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই-দাদা লজ্জাহীন ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন। ভাই বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। সঙ্গে এতগুলো রাজ্য সংস্থার প্রেসিডেন্ট, নিজেই হয়তো জানেন না। দাদা আইএফএ প্রেসিডেন্ট, অথচ প্রায় প্রতি সন্ধেয় বসে থাকেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে। ভাই মোহনবাগান কর্তা। তিন প্রধানের কর্তারা এখন তৃণমূল নেতাদের হাতের পুতুল। সিএবি’র প্রেসিডেন্টও ঠিক করা নবান্নের। সেখানেও অন্যায়ের প্রতিবাদ চুপ করাতে চলছে ‘দিদিকে বলে দেব’ আইন। ঋদ্ধিমান সাহাকে নিঃশব্দে কলকাঠি নেড়ে সরিয়ে দিয়েছেন গাঙ্গুলি ব্রাদার্স। কারও কোনও প্রতিবাদ নেই। ঋদ্ধিমানতো নবান্ন-অমিত শা-র দপ্তরে একসঙ্গে দোল খেতে পারেন না।
বাংলায় খেলার দুরাচারকে আরও বড় বৃত্তে ধরলে দেশের দুরাচারের ছবিটা স্পষ্ট হবে। এ কথা সত্যি, খেলায় ইদানীং প্রচুর টাকা ঢালছে কেন্দ্রীয় সরকার। কংগ্রেস শেষদিকে কমনওয়েলথ গেমসের জন্য খেলায় টাকা ঢালা শুরু করে। এমএস গিল, অজয় মাকেনরা ক্রীড়ামন্ত্রী থাকার সময় থেকে। ইদানীং আরও বেড়েছে তা। আবার স্বজনপোষণ এবং নিজস্ব লোক ঢোকানোর খেলা শিল্পের পর্যায়ে। ব্যাডমিন্টনে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেকদিন। কুস্তিতেও কুস্তিগিরদের মধ্যে ভাঙন ধরিয়েছেন নেতারা। যে খেলাটা এখন টাকার খনি, সেই ক্রিকেটে সচিব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে, কোষাধ্যক্ষ ক্রীড়া ও তথ্য সম্প্রসারণমন্ত্রীর ভাই। বোর্ডের আয় এবার ছিল ৬৫৫৮ কোটি, আগেরবার ৪৫৪২ কোটি টাকা। প্রেসিডেন্ট বিনি নীরব দর্শক। বোর্ড চালান মন্ত্রীর আত্মীয়েরাই। সাঁতারে পঞ্চাশ বছর ছড়ি ঘোরানো বীরেন্দ্র নানাবতি আড়াল থেকে ফেডারেশন চালান স্রেফ গুজরাটের লোক বলে। বিজেপি সরকার আপাতত লোকদেখানো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পদে থাকবেন নাকি শুধু খেলোয়াড়রাই। এটা স্রেফ কথার কথা। ফুটবলের কল্যাণতো এআইএফএফ প্রেসিডেন্ট স্রেফ বিজেপি নেতা বলে। তিনি আবার আইওএ-রও যুগ্মসচিব। আগে ছিলেন সিইও। কুবুদ্ধিটা কল্যাণকে দলের কোন নেতা দিয়েছেন জানি না, দুটো সংস্থায় মাথা ঘামাতে গিয়ে কল্যাণ ল্যাজেগোবরে। সম্পূর্ণ নড়ে গিয়েছে ফোকাস। এক বছরের মধ্যেই সঙ্গী সচিব সাজি প্রভাকরণকে সরিয়ে দিয়েছেন। ফুটবলে ডামাডোল।
খেলোয়াড় ক্ষমতায় এলেই প্রশাসন পালটাবে, ধারণাটা বছর দশেক আগেও বদ্ধমূল ছিল। এতদিনে পারগত সিং, প্রকাশ পাডুকোন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়দের দেখে সেই ধারণা ভেঙে গিয়েছে সম্পূর্ণ। এবা ক্ষমতায় এসে নতুন দিকের সন্ধান দিতে পারেননি। ভারতের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সংস্থা আইওএ-কে দেখুন। উষার সঙ্গে এখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট গগন নারাং, যুগ্মসচিব কল্যাণ। কমিটিতে মেরি কম, যোগেশ্বর দত্ত, দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎ কমল, রোহিত রাজপালের মতো পরিচিতরা। এরা এখনও ব্যর্থ। বোঝাপড়া নেই। সাক্ষীদের সমস্যা মেটানোর উদ্যোগই নিতে দেখা যায়নি। বরং উষা একধাপ এগিয়ে সাক্ষী-বজরং-বিনেশদের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। তিনি তখন স্রেফ নেতা। নারী হয়ে নারীর সম্মান নিয়ে উদ্বিগ্ন নন।
আমরা নেতাদের সম্পর্কে বলে থাকি, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। উষা-কল্যাণ-সৌরভ-বিনিদের মতো খেলোয়াড়-প্রশাসকদের সম্পর্কেও একই কথা বলে যেতে হবে। কী করে ভুলে যাব, লোধা কমিটির তৈরি নিয়ম পালটে ক্ষমতায় থেকে যেতে জয় শা’র সঙ্গে সৌরভের দিনের পর দিন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার ঘটনা? এই সুপারিশগুলোই কোনও ছুমন্তরে কার্যত ভ্যানিশ হতে বসেছে। আবার কিছু লোক ক্ষমতায় বসে থাকা নিয়ম করে নিল বলে।
চার বছর আগের হিসেব দেখেছিলাম, ক্রীড়া সংস্থা গুলোর ৪৭ শতাংশ প্রেসিডেন্ট রাজনীতিক। ৭৫ শতাংশ কর্তা নেতাদের আত্মীয়। খেলার প্রশাসনে থাকা মানে দারুণ ব্যবসা। প্রচারও মেলে, পদ কাজে লাগিয়ে ব্যবসারও উন্নতি হয়। দেশ-বিদেশের বিশাল অনুদান এলে টাকা তছরুপ শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলে কেউ কিছু করতে পারবে না। এক ঢিলে তিন পাখি। সেজন্যই ক্ষমতায় থাকতে এত প্রবল আকুতি। প্রিয় পাঠক প্রশ্ন করবেন, আসল দায়ী কারা? কুস্তির গড়াপেটার নির্বাচন বলে দিয়ে গেল, ক্ষমতালোভী নেতা এবং খেলোয়াড়দের উচ্চাকাঙ্খী বৃত্ত থাকবে। নিজস্ব স্বার্থেই থাকবে। আসল দায়ী আমরা সাধারণ মানুষই। এত দুর্নীতি, এত কেচ্ছার নায়ক ব্রিজভূষণ শরণ সিংদেরই শরণাগত থাকতে চাইব আমরা। দিনের পর দিন। নির্বাচনের পর নির্বাচন।