- সম্বিত পাল
বারামতির করাঞ্জে গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের সামনে গাছের ছায়ায় সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে যখন গোল হয়ে বসলেন তাঁরা, তখন মনে হল এঁরা সবাই ভাইপোর সমর্থকই হবেন। দুজনের গলায় ঘড়ি চিহ্নের উত্তরীয়। এখন মহারাষ্ট্রের মূল এনসিপি দলের ক্ষমতা যাঁর হাতে সেই ‘ভাইপো’ অজিত পাওয়ারের চিহ্ন ঘড়ি। এটিই মূল এনসিপি-র প্রতীক। অজিত অনেকদিন হল কাকা শারদ পাওয়ারের হাত থেকে দলের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছেন। মূল দল তাঁর হাতেই।
কিন্তু ভুল ভাঙল একটু পরেই। মারাঠি ও আধা-হিন্দিতে যখন মহারাষ্ট্রে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা উত্তপ্ত হতে শুরু করল, তার মাঝেই একজন কর্মী বাইকে করে এসে বাকি কয়েকজনের গলায় তুতারি (ভেঁপু) চিহ্নওয়ালা উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন। বোঝা গেল এঁরা আসলে অজিত নন, কাকা শারদ পাওয়ারের সমর্থক। কারণ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে শারদ পাওয়ারের এনসিপি গোষ্ঠীকে তুতারি চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। এই চিহ্ন নিয়েই শারদের মেয়ে সুপ্রিয়া সুলে এবারের লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন। উলটো দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী অজিতের স্ত্রী সুনেত্রা পাওয়ার।
যে কর্মীদের সঙ্গে বসে কথা হচ্ছিল, তাঁরা এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত একসঙ্গে শারদ ও অজিত পাওয়ারের হয়ে মানুষের কাছে যেতেন, দেখা গেল উত্তপ্ত আলোচনায় তাঁরাই এখন একে অন্যকে গালমন্দ করছেন। একদল বলছে, অজিত পাওয়ার ‘বিকাশ পুরুষ’ এবং তিনি বিজেপির হাত ধরে ভালো কাজই করেছেন। তো অন্য দলের বক্তব্য, শারদ পাওয়ার এই উন্নয়নের কাজ শুরু না করলে আর ভাইপোকে কাজ করার সুযোগ না দিলে অজিত পাওয়ার আজ কোথায় থাকতেন? তিনি বিশ্বাসঘাতক!
সারা বারামতি ঘুরে এই ঝগড়াই শুনতে পাওয়া গেল গ্রামে গ্রামে। কিন্তু সাধারণ মানুষ শুধু নয়, রাজনৈতিক কর্মীরাও যেন দ্বিধাবিভক্ত যে ভোটটি এবার কাকে দেবেন – বৌদিকে নাকি দিদিকে। সুনেত্রা পাওয়ার না সুপ্রিয়া সুলেকে। এখনও ঠিক করে উঠতে পারছেন না।
বারামতির এই লড়াই যেন পুরো মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক ছবিকে স্পষ্ট করে দেয়। কারণ শুধু তো এনসিপি ভাঙেনি। বিজেপি নেতারা ভেঙেছেন উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনাকেও। ২০২২ সালে শিবসেনা ভেঙে তার দলের নেতা একনাথ শিন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে বিজেপি। সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাচন কমিশনে লড়াই শেষে শিন্ডের গোষ্ঠীকেই শিবসেনার আসল প্রতীক িতরধনুক চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। আর শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব ঠাকরের ছেলে উদ্ধবকে মশাল চিহ্ন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সুতরাং ২০১৯ সালে যেখানে দুই পক্ষে দুটি করে বড় রাজনৈতিক দল জোট করে নির্বাচনে লড়েছিল এবার সেখানে চারের জায়গায় ছয়টি দল নির্বাচনে লড়ছে। বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেছে একনাথ শিন্ডের শিবসেনা আর অজিত পাওয়ারের এনসিপি। তারা হল মহায়ুতি। আর অন্যদিকে শারদ পাওয়ারের এনসিপি, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এবং কংগ্রেসের মহা বিকাশ আঘাড়ি।
শিবসেনার সমর্থক ও এনসিপি-র সমর্থকরা পড়েছেন সমস্যায়। কেউ কেউ আবেগতাড়িত। একনাথ শিন্ডে ও অজিত পাওয়ারকে বিশ্বাসঘাতক মনে করছে একদল। শিন্ডে কী করে বালাসাহেবের ছেলেকে এভাবে বেকায়দায় ফেলল – প্রশ্ন উঠছে। আর কাকা শারদ পাওয়ারের কাছ থেকে সব পেয়ে কী করে ‘তাঁর পিঠেই ছুরি মারল’ ভাইপো অজিত – উঠছে এই প্রশ্নও।
এই আবেগেই বাজিমাত করতে চাইছে বিজেপি। আরও স্পষ্ট করে বললে মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। এই বিজেপি নেতার অঙ্গুলিহেলনেই শিবসেনা ও এনসিপি-র ভাঙন। সবাইকে অবাক করে নাগপুরের এই বিজেপি নেতাকেই ২০১৪ সালে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শা। লক্ষ্য ছিল শিবসেনার ঘাড়ে চেপে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি। এই অভিসন্ধি বুঝেই উদ্ধব ঠাকরে ২০১৯ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পরে কংগ্রেস ও এনসিপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে।
কিন্তু দমে যাননি ফড়নবিশ। দুই দলের দুটি গোষ্ঠীকে লড়িয়ে দিয়ে ফায়দা তুলতে চাইছেন তিনি। শিবসেনাকে ভেঙে থানের নেতা একনাথ শিন্ডেকে নিজের দিকে এনেছেন। মোদি-শা’র পরামর্শে নিজে শেষ মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী পদ নেননি। সেই পদ দিয়েছেন শিন্ডেকে। একই সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের ভাঙিয়ে নিয়ে আসতেও পিছপা হননি বিজেপি নেতারা। কংগ্রেস নেতা ও মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চ্যবন দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। অন্য এক কংগ্রেস নেতা মিলিন্দ দেওরাকে একনাথ শিন্ডের শিবসেনা কাছে টেনে নিয়েছে। সাসপেন্ড হওয়া কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় নিরুপমও শিবসেনায় যোগ দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। বিজেপির মূল লক্ষ্য মহারাষ্ট্রে দলের একছত্র শাসন কায়েম করা। ফল ভালো করতে পারলে শিন্ডে বা অজিত পাওয়ার কারও দিকেই আর ফিরে তাকাবেন না মোদি-শারা।
মুম্বই ও কঙ্কণ (উপকূলবর্তী অঞ্চল) থেকে শিবসেনার একছত্র আধিপত্য খতম করতে চাইছেন ফড়নবিশ। অন্যদিকে, মারাঠওয়াড়া অঞ্চল থেকে পাওয়ারদের আধিপত্য খর্ব করতে চাইছে নরেন্দ্র মোদির দল। আর সাধারণ ভোটাররা যাঁরা বিজেপি-বিরোধী তাঁরা এই সমীকরণেই ঘোর আপত্তি তুলছেন ঘরোয়া আলোচনায়। অজিত পাওয়ারকে তো দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই দিতেই মোদিরা নিজেদের দিকে নিয়েছেন। তবে ফড়নবিশদের কৌশলে বিজেপির সমর্থকরা মনে বল পেয়েছেন। মোদি তাঁদের রক্ষাকর্তা হয়ে আসবেন বলে মনে করছেন।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মারাঠাদের সংরক্ষণ নিয়ে আন্দোলন। মনোজ জারাঙ্গে পাটিলের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হয়েছে কয়েক মাস আগেই। সরকার বাধ্য হয়েছে মারাঠাদের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করতে। তাতেও মন গলেনি মনোজদের। এই সংরক্ষণে আবার ওবিসি জাতিগোষ্ঠী বিরক্ত। তাঁদের নেতারা বলছেন, পিছিয়ে পড়া জাতির লোকেদের বঞ্চিত করে মারাঠাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে।
এই ভাগাভাগির রাজনীতির মাঝে নরেন্দ্র মোদির ম্যাজিক মারাঠিদের মধ্যে কতটা কাজ করে সেই দিকে তাকিয়ে আছেন বিজেপি নেতারা। শিবসেনা ও এনসিপি-র দুটি গোষ্ঠী যে নিজেদের মধ্যে লড়াই নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। কে কাকে ছাপিয়ে যেতে পারে, সেই দিকেই নজর দেবে এবং বিজেপির দিকে বিশেষ নজর দেবে না, এ নিয়ে একপ্রকার নিশ্চিত দেবেন্দ্র ফড়নবিশরা।
চিন্তা, এই ভাগাভাগিতেও গতবারের আসন সংখ্যা ধরে রাখা যাবে তো! ২০১৯ সালে শিবসেনার সঙ্গে জোট বেঁধে ২৫টি আসনে লড়েছিল বিজেপি। জিতেছিল ২৩টি আসন। শিবসেনা জিতেছিল ১৮টি। মহারাষ্ট্রের ৪৮টি আসনের মধ্যে ৪১টিই গিয়েছিল এনডিএ-র ঝুলিতে। এনসিপি চারটি ও কংগ্রেস একটি আসন পেয়েছিল গতবার। একনাথ শিন্ডে আর অজিত পাওয়ারকে নিয়ে বিজেপি এবার ৪০ পার করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
কারণ আসন ভাগাভাগি নিয়ে মহায়ুতি ও মহা বিকাশ আঘাড়ি দুই পক্ষই বিস্তর সময় নিতে বাধ্য হয়েছে। বিভক্ত শিবসেনা ও এনসিপি-কে বেগ পেতে হয়েছে প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে। অনেকেই প্রার্থী হতে চেয়েও দলের টিকিট পাননি। প্রধানমন্ত্রী মহারাষ্ট্রে এসে শারদ পাওয়ারের নাম না করে ‘অতৃপ্ত আত্মার’ কথা তুলেছেন। ভোটারদের মনে করিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ১৯৭৮ সালে কংগ্রেসের বিধায়ক ভাঙিয়ে শারদ পাওয়ার নিজে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বলেছেন, শারদ পাওয়ার নিজের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখা ছাড়া আর বিশেষ কিছুতেই মন দেন না। কিন্তু এই মহায়ুতি ও মহা বিকাশ আঘাড়ির লড়াইয়ে যে মহারাষ্ট্রে কত ‘অতৃপ্ত আত্মার’ জন্ম হচ্ছে তা সময়ই বলবে।
(লেখক পুনের বাসিন্দা। অধ্যাপক ও সাংবাদিক)