প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: বিজয়াদশমীতে দিল্লির ঐতিহাসিক রামলীলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হওয়া দশেরায় ‘রাবন-দহন’ দেখতে প্রতিবছর ভিড় করেন হাজার হাজার মানুষ। বিগত চার দশক ধরে দশমীর দিন এই অভিনব রামলীলা এবং দেশের সুউচ্চ দহনপর্ব দেখতে উপচে পড়ে ভক্তসমাগম, সারারাত ধরে চলে উৎসব। বিশেষ করে রামলীলার শেষপর্বে রাবন, কুম্ভকর্ণ এবং মেঘনাদের সুউচ্চ মূর্তির দহন পর্ব হচ্ছে অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ। এবার সেই অনুষ্ঠানে আনা হচ্ছে ব্যতিক্রমী সংযোজন, রামলীলায় তিন ‘আসুরিক শক্তি’র দৃষ্টান্ত স্বরূপ রাবন, মেঘনাদ ও কুম্ভকর্ণের মূর্তির পাশাপাশি গড়ে তোলা হবে দহনযোগ্য চতুর্থ মূর্তি। বিশেষ এই মূর্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সনাতনী ধর্মের ‘বিদ্রোহী'(শত্রুও বলা যেতে পারে)রূপে, এমনই দাবি দিল্লির লবকুশ রামলীলা মহাসংঘ কমিটি সূত্রে। আগামী ২৪ অক্টোবর দশেরার সময় দিল্লি জুড়ে ৬৫০ টি ছোটবড় রামলীলা কমিটি সনাতন ধর্ম ‘বিদ্রোহী’দের কুশপুত্তলিকা দাহ করবে বলেই জানা গিয়েছে যার নেপথ্যে পরোক্ষ মদত আছে কেন্দ্রীয় গেরুয়া শিবিরের।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এবং ডিএমকে সুপ্রিমো এম কে স্ট্যালিনের ছেলে উদয়নিধির সনাতন ধর্ম প্রসঙ্গে বিতর্কিত মন্তব্যের পরেই বিষয়টিকে প্রচারের হাতিয়ার করে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপি। এতে রাজনৈতিক লাভ হতে পারে অনুমান করে ওই প্রচারকে ধীরে ধীরে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বও। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ও পরে মধ্যপ্রদেশে প্রথম বার প্রকাশ্যে ওই মন্তব্যের সমালোচনা করে সরব হন। ডিএমকে নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় তুলে সামগ্রিক ভাবে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটকেই আক্রমণ শানানোর কৌশল নেন প্রধানমন্ত্রী-সহ বিজেপি নেতৃত্ব। প্রায় একইসময়, ‘ভারত’ বনাম ‘ইন্ডিয়া’ বিতর্ক উত্থাপিত হলেও, প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের সব কিছু ভুলে সনাতনী বিতর্ক নিয়ে বিরোধীদের মুখের মতো জবাব দেওয়ার খোলা নির্দেশ দেন। এবার সনাতনী ধর্ম বিষয়ক বিতর্ক এবার জনমানসে আরও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আসন্ন ২৪ অক্টোবর দশেরা উপলক্ষে ‘সনাতন ধর্ম বিদ্রোহী’ শীর্ষক কুশপুত্তলিকা দাহ করার মাধ্যমে সেই বিতর্কের আঁচ আরও দ্বিগুণ বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে দিল্লির রামলীলা মহাসংঘ।
এই প্রসঙ্গে দিল্লির রামলীলা মহাসংঘের সভাপতি অর্জুন কুমার জানিয়েছেন, ‘দিল্লি এবং এনসিআর জুড়ে প্রায় ৬৫০ টি রামলীলা কমিটি আছে। গত ১ অক্টোবর কমিটিগুলি গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠকে বসে এই অভিনব উদ্যোগ গ্রহণে সম্মতি দেয়।’ অর্জুন কুমারের দাবি, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সনাতন ধর্ম, ঐতিহ্য এবং পরম্পরা বিরূদ্ধে চোরা ষড়যন্ত্র চলছে। তথাকথিত একশ্রেণীর গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ইচ্ছা করে দেশের সনাতনী ভাবধারাকে কষাঘাত করতে চাইছেন। তাঁরা দেশের অখণ্ডতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরোধী। দশেরার দিনে অন্যতম আসুরিক শক্তির প্রতিভূ হয়ে ওঠা এই সনাতনী বিদ্রোহী বা শত্রুদের প্রতি খোলা বার্তা দিতেই এই বিশেষ আয়োজন।’ প্রশ্ন ওঠে এক্ষেত্রে ‘সনাতনী ধর্ম বিদ্রোহী’ বলতে কাদের চিহ্নিত করতে চাইছে রামলীলা কমিটি। সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর না দিলেও রামলীলা মহাসংঘের সভাপতি জানান, ‘সনাতন ধর্মের শত্রুরা যুগে যুগে বিভিন্ন রূপে অবতীর্ণ হয়েছে। এক্ষেত্রে এক কথায় তাদের পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়৷ রাবন দহনের মতোই এই দহনও একটি প্রতীকী মাত্র। তবে চিতোরের রাণা রতন সিং, পৃথ্বীরাজ চৌহান বা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ যাদের বিরুদ্ধে তরবারি ধরেছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরা এবং তাঁদের উত্তরসূরীদের সনাতন ধর্মের বিদ্রোহী বলে অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়।’ রামলীলা মহাসংঘ ‘বিদ্রোহী’ বা শত্রুদের প্রত্যক্ষ নাম না নিয়ে সরাসরি দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিই যে তর্জনি নিক্ষেপ করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
স্বাভাবিক ভাবেই এহেন কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে উঠেছে আদালতের প্রসঙ্গও। উল্লেখ্য সনাতন ধর্ম বিতর্ক ইতিমধ্যে গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। তবে মাদ্রাজ হাইকোর্ট জানিয়েছে, সংবিধান স্বীকৃত বাক স্বাধীনতাকে ঘৃণাসূচক মন্তব্য বলে উল্লেখ করা যায় না। মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি এন শেসাশেয়ীর পর্যবেক্ষণ, ‘সনাতন ধর্ম একটা শ্বাশত কর্তব্য। হিন্দুধর্মের নানা শাখা থেকে এই চিরন্তন বা শ্বাশত কর্তব্যগুলি উঠে এসেছে। যারা হিন্দুত্বের মাধ্যমে গোটা জীবনটা পরিচালনা করছেন তাদের মধ্যে এই গুলি যুক্ত হয়। তার মধ্যে রয়েছে দেশের প্রতি কর্তব্য, রাজার কর্তব্য, প্রজাদের প্রতি রাজার কর্তব্য, বাবা মা এবং গুরুর প্রতি কর্তব্য। এছাড়াও গরিবদের প্রতি যত্নবান হওয়া তথা আরও অনেকের প্রতি কর্তব্যবোধকে জাগরিত করাও শেখায় সনাতন ধর্ম।’ বিচারপতি শেসাশেয়ীর মতে, ‘আসলে সময়ের সঙ্গে ধর্মীয় আচারের মধ্যে কিছ কুপ্রথা প্রবেশ করে। তারা আগাছার মতো। কিন্তু আগাছার জন্য শস্যকে কেন কেটে ফেলবেন?’ মাদ্রাজ হাইকোর্ট জানিয়েছে, ‘এটা নিশ্চিত করাটা খুব দরকার যে যখন কথা বলার স্বাধীনতা ধর্ম সম্পর্কে থাকে সেটা যেন কাউকে আঘাত না করে।’ এই সূত্রে রামলীলা মহাসংঘ সভাপতির দাবি, ‘আদালতের প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং শ্রদ্ধাশীল আমরা। আদালত তার সুচারু পর্যবেক্ষণ রেখেছে। আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করব। কোনও বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের ক্ষোভ নেই। কিন্তু সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে যারা সরব হবে, আমরা তার বিরোধিতা করবই।’ তিনি এও বলেন, ‘রাবন, মেঘনাদ এবং কুম্ভকর্ণের পাশাপাশি এবছর পোড়ানো হবে আরো একটি ছোট আসুরিক মূর্তি, যার নাম সনাতন ধর্ম বিদ্রোহী। এই পদক্ষেপ নিয়ে কারুর বিরুদ্ধমত থাকতেই পারে। আমরা আমাদের পরিকল্পনামাফিকই কাজ করব।’ তবে এহেন উদ্যোগের নেপথ্যে বিজেপির প্রত্যক্ষ মদতের কথা অস্বীকার করেছেন অর্জুন কুমার। তাঁর দাবি, ‘বহু বিজেপি নেতাই রামলীলার সঙ্গে জড়িত। সময়-অসময়ে তাঁরা সুপরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে শেষ সিদ্ধান্ত থাকে আমাদেরই।’