Wednesday, May 1, 2024
Homeজাতীয়নির্বাচন মানে হিংসার ছাড়পত্র নয়, রাজ্যের দাবি ওড়ালো সুপ্রিম কোর্ট

নির্বাচন মানে হিংসার ছাড়পত্র নয়, রাজ্যের দাবি ওড়ালো সুপ্রিম কোর্ট

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে মোতায়েন হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সুপ্রিম কোর্টে ধোপে টিকল না রাজ্য সরকার বা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কোনও যুক্তি। পঞ্চায়েত ভোটের আয়োজন করতে হবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতেই, কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে বহাল রেখে জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট৷ মঙ্গলবার দেশের শীর্ষ আদালতের অবকাশকালীন বেঞ্চের দুই বিচারপতি বিভি নাগরত্না এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান, হিংসার আবহে স্বচ্ছ, এবং অবাধ নির্বাচন কোনওভাবেই সম্ভব নয়৷ মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের আয়োজন মানে হিংসাকে ছাড়পত্র দেওয়া নয়৷

এই প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালতের রায়, কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু পঞ্চায়েত ভোটের আবহ তৈরি করতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে, সেই নির্দেশে হস্তক্ষেপ করার কোনও প্রয়োজনীয়তা তাঁরা বোধ করছেন না৷ একইসঙ্গে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় সওয়াল ও যুক্তিকে নস্যাত্‍ করে বিচারপতি নাগরত্নার পর্যবেক্ষণ, নির্বাচন মানেই বেলাগাম হিংসা নয়৷ কলকাতা হাইকোর্ট অতীতে ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে রাজ্যে বেনজির হিংসার সাক্ষী থেকেছে৷ সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের এই সিদ্ধান্ত৷ ভোটের পাশাপাশি সমানতালে হিংসা চলতে পারে না৷ যদি কোনও ব্যক্তি মনোনয়ন দাখিল করতে না পারেন, তাদের হত্যা করা হয়, তাহলে সেই নির্বাচনি আবহকে কোনওভাবেই স্বচ্ছ এবং অবাধ বলা যায় না৷ রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায় রক্তাক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে, অশান্তি হচ্ছে, এই আবহে নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ বলা যায় কি?

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার শীর্ষ আদালতে শুনানি পর্বের শুরুতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে সওয়াল করতে উঠে প্রবীণ আইনজীবী মীনাক্ষী অরোরা সাফ জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে কমিশন বাহিনী চাইতে পারে, তবে তা জোগান দিতে হবে রাজ্যকেই৷ এই ক্ষেত্রে কমিশনের করণীয় কিছু নেই৷ তিনি এও জানান, কমিশনের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার যে অভিযোগ উঠেছে তা ভিত্তিহীন৷ একইসঙ্গে তিনি বলেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত ভোটকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য সবরকমের ব্যবস্থা নিয়েছে৷ রাজ্য সরকার যথাসম্ভব সাহায্য করছে। তারপরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল কমিশনের বিরুদ্ধে স্তাবকতা এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনছে৷ মীনাক্ষী অরোরার যুক্তি, ৮ জুন ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়৷ নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ কি নেওয়া হবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ৯ জুন বৈঠকে মিলিত হন রাজ্যের মুখ্যসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনার৷ তাহলে ৯ তারিখ সকালে কমিশনের অবস্থানের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হল কোন যুক্তিতে?

একই সুরে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে সওয়াল করতে ওঠা প্রবীণ আইনজীবী সিদ্ধার্থ আগরওয়াল বলেন, ‘এবারের পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে মোট আসন প্রায় ৭৫,০০০, বুথের সংখ্যা ৬১,৬৩৬৷ এর মধ্যে ১৮৯টি বুথকে স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এই বুথগুলিকে বাড়তি নিরাপত্তা বলয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে৷ সেখানে কলকাতা এবং রাজ্য পুলিশ দায়িত্বে থাকবে৷ অতিরিক্ত বাহিনী প্রয়োজন হলে প্রতিবেশী পাঁচটি রাজ্য থেকে সুরক্ষা বাহিনী নিয়ে আসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে৷ তারপরও হাইকোর্ট গোটা রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার রায় দিয়েছে৷ রাজ্য সরকারকে সবিস্তারে বক্তব্য রাখার সুযোগ না দিয়ে কোন যুক্তিতে এই রায় দেওয়া হচ্ছে তা কিন্তু জানায়নি কলকাতা হাইকোর্ট৷

রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সম্মিলিত যুক্তিকে খন্ডন করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর আইনজীবী হরিশ সালভে৷ বর্ষীয়ান আইনজীবী সালভের দাবি, কলকাতা হাইকোর্ট একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ অতীতে ২০১৩, ২০১৮ সালে একাধিকবার ভোট সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সাক্ষী থেকেছে পশ্চিমবঙ্গ৷ রাজ্য যেখানে নিজেদের পর্যাপ্ত বাহিনীর অভাবে পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে বাহিনী ধার নিচ্ছে, সেখানে বিনামূল্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হলে সমস্যা কোথায়? সালভের মতে, ‘রাজ্য মনে করছে কেন্দ্রীয় বাহিনী মানেই বুঝি মিলিটারি শাসন, বিরোধী সেনা দিয়ে রাজ্য মুড়ে ফেলা হবে। এই মানসিকতা দুর্ভাগ্যজনক।’ তিনি এও বলেন, ‘মাত্র ১৮৯টি স্পর্শকাতর বুথের মধ্যে আটকে গেলে চলবে না৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার হাইকোর্টের আদেশে বিক্ষুদ্ধ কেন? আসলে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে চায় না ওরা৷’

এদিন হরিশ সালভে মনে করিয়েছেন, ‘রুল অফ ল এবং ল অফ রুলার (আইনের শাসন ও শাসকের আইন) দুটি পৃথক অধ্যায়৷ এখানে দ্বিতীয় পর্বটির কোনও স্থান নেই। আসলে সার্বিকভাবে নির্বাচনি সুরক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যর্থ রাজ্য সরকার৷ আসলে ওরা (রাজ্য সরকার) তৈরিই নয় পঞ্চায়েত ভোট করানোর জন্য৷ কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না রাজ্য সরকার, তাই কি তাদের এই উদ্বেগ? কেন্দ্রীয় বাহিনী কি রাজ্য জুড়ে দাঙ্গা করবে? গণতন্ত্রে এমন ধ্যান ধারণা কাম্য নয়।’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর হয়ে সওয়াল করা প্রবীণ আইনজীবী বিবেক তংখাও সমর্থন করেন কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে৷ তাকে সমর্থন করেন আবেদনকারীদের আইনজীবী মনিন্দর সিংও৷

এরপরই রায়দান করতে উদ্যোগী হন শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতি৷ কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত ভোটের আয়োজন করার জন্যই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে, জানান বিচারপতি নাগরত্না৷ এই রায়ের উপরে তাঁরা কোনওপ্রকার হস্তক্ষেপ করবেন না, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে দায়ের করা মামলা খারিজ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি ভি নাগরত্না ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রার অবকাশকালীন বেঞ্চ। শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বিভি নাগারত্নার গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, ‘নির্বাচন মানেই হিংসা নয়৷ নির্বাচন মানেই হিংসার ছাড়পত্র দেওয়া নয়৷ ভোটের পাশাপাশি হিংসা চলতে পারে না৷ যদি কোনও ব্যক্তি মনোনয়ন দাখিল করতে না পারেন, তাদের হত্যা করা হয়, তাহলে সেই নির্বাচনি আবহকে কোনওভাবেই স্বচ্ছ এবং অবাধ বলা যায় না৷’ নাগরত্না এও বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ তীব্র হচ্ছে, অশান্তি হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে কি শান্তিপূর্ণ বলা যায়?’ তাঁর যুক্তি, পাঁচ রাজ্যের পুলিশ চেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ৷ হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার কথা বলেছে৷ এর খরচ দেবে কেন্দ্রীয় সরকার৷ তাহলে রাজ্যের সমস্যা কোথায়? কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে চিন্তিত কেন রাজ্য? ‘আপনাদের কাজ আপনারা করুন, বাহিনী কোথা থেকে আসবে সেটা ভাবতে হবে না’ – এই মর্মে চরম ভর্ৎসনাও করেন বিচারপতি নাগরত্না। এরপর কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে তার বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় পিটিশন খারিজ করে দেন তিনি।

প্রসঙ্গত, পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে, এমনই নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। সেই নির্দেশ না মানার অভিযোগ নিয়ে বিজেপি এবং কংগ্রেসের তরফে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে আদালত অবমাননার আবেদন জানানো হয় সোমবার। তবে কলকাতা হাইকোর্টের কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত ওই নির্দেশ শেষ পর্যন্ত বহাল থাকবে কিনা, তা নিয়ে এদিন সকলেই নজর রেখেছিল সুপ্রিম কোর্টে। শীর্ষ আদালতের রায়ের উপরেই রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নির্ভর করছে বলে মনে করা হয়। অবশেষে এদিন বিস্তর সওয়াল জবাব শেষে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ই অপরিবর্তিত রাখল শীর্ষ আদালত। বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, হাইকোর্টের রায় সুপ্রিম কোর্টে বহাল থাকায় রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন কার্যত চূড়ান্ত হয়ে গেল। প্রত্যাশিতভাবেই এই রায়ে চরম অস্বস্তির মুখে পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠল রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও। এই রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে কোনও ‘রিভিউ পিটিশন’ দাখিল করে কিনা রাজ্য সরকার, তাই দেখার বিষয়।

Sushmita Ghosh
Sushmita Ghoshhttps://uttarbangasambad.com/
Sushmita Ghosh is working as Sub Editor Since 2018. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad Digital. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Viral Post | ধনী ঘরের ছেলে চাই, মেয়ের ঘটকালির জন্যই তিন লক্ষ টাকা খরচ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রসঙ্গ যখন সন্তানের বিয়ের, তখন বাবা-মায়েরা সবথেকে ভালো পাত্র-পাত্রীর খোঁজ করেন। তবে আজকালকার দিনে বিয়ের সম্বন্ধ খোঁজা আর জটিল ব্যাপার...

Kunal Ghosh | ‘যিনি চাকরি বিক্রিতে যুক্ত তিনি এখনও রাজ্যের মন্ত্রী’, বিস্ফোরক ‘অপসারিত’ কুণাল...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়ের প্রশংসা করায় দলীয় পদ থেকে কুণাল ঘোষকে অপসারণ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর এরপরই রাজ্যের নিয়োগ দুর্নীতি...
weather-update-in north bengal

Weather Report | অবশেষে স্বস্তি, ঝড়বৃষ্টিতে ভাসল রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: অবশেষে তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে মিলল স্বস্তি।  আগামী দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা সংলগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির পূর্বাভাস...

Kunal Ghosh | অপসারণের পরই অভিমানী কুণাল! আমাকে কি এখন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ দল বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে বিবৃতি প্রকাশ করে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে কুণাল ঘোষকে সরিয়ে দিল তৃণমূল কংগ্রেস। বুধবার বিকেলে...

Congress | ‘ভোটে হারলে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেব’, ভোটারদের হুমকি কংগ্রেস বিধায়কের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কংগ্রেস হেরে গেলে কেটে দেওয়া হবে বিদ্যুৎ সংযোগ। বুধবার ভোটারদের (Voter) ঠিক এই ভাষাতেই হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠল কর্ণাটকের (Karnataka)...

Most Popular