কৌশিক দাস, ক্রান্তি: বিজেপি-তৃণমূলের রাজনৈতিক আকচা-আকচিতে গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প বন্ধ। অতীতে যারা কাজ করেছেন তাঁরা কবে এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বকেয়া টাকা হাত পাবেন তাও আজানা। আদৌ পাবেন কিনা তাও অনিশ্চিত। বিপুল অংকের বকেয়া আদায়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাছোড়। পালটা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর টাকা বন্ধের ‘সুপারিশ’-এ শতাধিক কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে এসেছে। প্রকল্পের সমস্ত হিসেব সহ বাস্তব পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবুও টাকা আসেনি। এরই মধ্যে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম। এই পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজে পাড়ি দিচ্ছেন ক্রান্তি ব্লকের বহু তরুণ। যদিও এ ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য না থাকলেও সংখ্যাটা যে বেশ কয়েকশো, তা মেনে নিয়েছেন একাধিক পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিরা। ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে এঁদের অনেকেই গুরুতর জখম হচ্ছেন। কেউ কেউ ফিরছেন কফিনবন্দি হয়ে। তথাপি পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁদের দেশময় ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদি যতই বছরে দু’কোটি তরুণ-তরুণীকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিন না কেন প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসে গত পাঁচ বছরে তিনি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। রেল সহ একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে হাজার হাজার পদ শূন্য। কিন্তু সরকারি চাকরির দরজা বন্ধ। বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও তথৈবচ। তাই অবিশ্বাস্য হলেও বহু শিক্ষিত ছেলে জীবিকার সন্ধানে এখন পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করছেন। অনেকে মন দিয়েছেন কৃষিকাজে। একটি বড় অংশের তরুণ টোটো চালিয়ে স্বনির্ভর হয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতেও সংসারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে ক্রান্তি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পঞ্চানন রায় বলেন, ‘১০০ দিনের কাজে গোটা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এক নম্বরে ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় এই প্রকল্পের বকেয়া টাকা দেওয়া হচ্ছে না। তবুও রাজ্য সরকার ৫০ দিনের কাজ চালু করতে চলেছে। বঙ্গবাসীকে বাংলার বাইরে গিয়ে যাতে কাজ করতে না হয় সেজন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় পাশে রয়েছেন।’ এই অভিযোগ উড়িয়ে বিজেপির মহিলা মোর্চার জেলা সভানেত্রী দীপা বণিক বলেন, ‘রাজ্য সঠিক হিসেব না দিয়ে শাসকদলের নেতাদের পকেটে টাকা ভরতে সাহায্য করছে। বাংলায় কোনও কাজ নেই। বেকারত্ব বাড়ছে। তাই, বাংলা থেকে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ছে।’
সম্প্রতি মাল ব্লকের কুমলাইয়ের একজন ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। এর আগে কাঁঠালগুড়ির তরুণ ডাবলু রায় কাজ করতে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙে বর্তমানে শয্যাশায়ী। একই হাল দক্ষিণ হাঁসখালির তরিফুল ইসলামের। সিকিমে কর্মরত ষোলঘরিয়ার অজিত ওরাওঁ সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘দৈনিক কাজের সুযোগ কমছে। কিছুদিন দৈনিক মজুরিতে কাজ করেছিলাম। কিন্তু তাও অনিয়মিত। তাই অন্যত্র যেতে হয়েছে।’ ওই এলাকার রতন ওরাওঁ, নিমাই ওরাওঁ, বাজু ওরাওঁদের মতো অন্তত ১৫ জন কেরল সহ দক্ষিণের নানা রাজ্যে কর্মরত। রাজাডাঙ্গার উলেশ রায়, ডালু রায়, সুবল রায়দের অভিযোগ, স্থানীয় কাজে মজুরি খুবই কম। তাই, অন্যত্র যেতে হয়। স্থানীয় রহিদুল ইসলামের কথায়, ‘আমাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। অনেকের মৃত্যু দেখেছি। অনেকে মারাত্মক জখম হয়ে ফিরেছে।’ ব্লকের বারোঘরিয়া, আনন্দপুর, কৈলাসপুর কিংবা মাঝগ্রাম, লাটাগুড়ির বহু মানুষ এভাবেই দৈনিক দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছেন।