শালকুমারহাট: রাত সাড়ে আটটা। রাস্তার মোড়ে আড্ডায় বসে তিন-চারজন কিশোর। রাভাবস্তিতে এমন ছবি দেখে অভ্যস্ত শালকুমারহাট (Salkumarhat) বিটের বনকর্মীরা। পড়াশোনার সময় ছেলেরা হয় আড্ডা দিচ্ছে, না হয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এবার থেকে বস্তিতে এমনটা আর হবে না, অন্তত সেটাই লক্ষ্য। অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবেন বনকর্মীরা। বস্তির বাসিন্দারা এই উদ্যোগকে সমর্থন করছেন।
এরকম উদ্যোগের মূল কারণ হল, শিক্ষার প্রতি অনীহা। এবার বস্তির চারজন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে একজন। এমনকি ওই বস্তি থেকে এখনও পর্যন্ত কেউ স্নাতক পাশ করেননি। তাই বন দপ্তর চাইছে, বণ্যপ্রাণীর গতিবিধির পাশাপাশি বস্তির পড়ুয়াদের প্রতিও নজর চালাতে।
জলদাপাড়া সাউথ রেঞ্জের শালকুমারহাট বিটের রাভা বনবস্তিতে ৮৫টি পরিবারের বসবাস। লোকসংখ্যা প্রায় ৫০০। দেশ স্বাধীনের আগে থেকে জঙ্গলে ঘেরা এই বস্তিতে রাভা সম্প্রদায়ের বাস। তবে এখনও সেভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। বস্তিতে প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। তাই প্রাথমিক শিক্ষাটুকু সবাই পায়। কিন্তু বস্তি থেকে হাইস্কুলের দূরত্ব প্রায় ১০ কিমি। সেখানে ভর্তি হলেও সবাই হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারে না। গত বছর বস্তির দুজন মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। দুজনই অনুত্তীর্ণ হয়। সেই দুজন সহ এবার মোট চারজন মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। গতবারের দুজন এবারও পাশ করতে পারেনি। নতুনদের একজন অনুত্তীর্ণ। মাধ্যমিকে এবার মাত্র ৩৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে নাসিমা রাভা। এদিন সকালে নাসিমার বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যান বনকর্মীরা। এবার বস্তির চারজন পরীক্ষার্থী বন দপ্তরের গাড়িতে পরীক্ষাকেন্দ্রে যাতায়াত করেছিল। তাই ফলাফলের দিকে নজর রেখেছিল বন দপ্তরও। কিন্তু সার্বিক ফলাফলে বনকর্মীরা হতাশ।
নাসিমার বাবা বিলিয়ন রাভা পরিযায়ী শ্রমিক। তবে সদ্য বাড়ি ফিরেছেন। বলছিলেন, ‘মেয়েকে তো কলেজ পর্যন্ত পড়াতে চাই। কিন্তু নিজের আর্থিক অবস্থা ভালো নেই। তবু চেষ্টা করব।’ নাসিমা শিলবাড়িহাট হাইস্কুলের ছাত্রী। তার কথায়, ‘বস্তির বাইরে গিয়ে দুটি ব্যাচে টিউশন পড়েছি। স্কুল রোজ যেতে পারিনি। তাই পাশ করলেও রেজাল্ট বেশি ভালো হয়নি। তবে স্নাতক স্তরে পড়তে চাই।’
শালকুমারহাটের বিট অফিসার সুজিত সরকারের নেতৃত্বে বনকর্মীরা এদিনই রাভাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সচেতন করেন। বৃহস্পতিবার রাতেও পড়াশোনা নিয়ে রাভাদের সঙ্গে বন দপ্তরের মিটিং হয়। বিট অফিসার জানিয়েছেন, অভিভাবকদের থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। এদিন থেকে স্কুল পড়ুয়াদের প্রতি তাঁরাও নজরদারি চালাবেন। কারণ, বস্তিতে পড়াশোনার পরিবেশ মোটেই ভালো নয়। মেয়েদের থেকে ছেলেরা পড়াশোনায় আরও পিছিয়ে। তিনি বলছিলেন, ‘সকালে ও সন্ধ্যার পর ছাত্রছাত্রীরা যাতে নিয়মিত পড়াশোনা করে, এজন্য রাতে রাস্তায় কাউকে আড্ডায় বসতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে শাসন করা হবে।’
বস্তির সচেতন বাসিন্দারাও খুশি। নীলকমল রাভা বলছিলেন, ‘আমরা অভিভাবকরা সবাই পড়াশোনার বিষয়ে সচেতন নই। তাই এখন থেকে যদি বনকর্মীরা বস্তির ছেলেমেয়েদের প্রতি নজর দেন, তাহলে ভালো হয়। আমরাও চাই, পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হোক।’ রাম রাভা, বচন রাভা, মন্টু রাভাদেরও একই বক্তব্য।