Friday, May 3, 2024
Homeকলামগণতন্ত্রের ব্যাকরণটা ঘেঁটে যাচ্ছে নির্বাচনে

গণতন্ত্রের ব্যাকরণটা ঘেঁটে যাচ্ছে নির্বাচনে

  • গৌতম সরকার

উশখুশ শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্য কথা ভালো লাগে না কারও। কিছু বললে একই প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে আসে, দাদা, হবেটা কী? মানে কোন দল জিতবে বলুন না? আপনারা তো টের পান। শেষ হাসি হাসবে কে? যদিও সবে কলির সন্ধে। ভোট এখনও দেড় মাস। যা দুঃসহ গরমের পূর্বাভাস, তাতে গণনা পর্যন্ত সুস্থ থাকলে হয়। কিন্তু এ সব গালগল্পে চিঁড়ে ভেজে না। কৌতূহলকে তো দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না।

কেন জানি মনে হচ্ছে, সাড়ে চার দশকেরও বেশি আগের স্মৃতি। আমার কলেজ জীবন তখন শেষ হব হব করছে। বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল সেবার। আলিপুরদুয়ারে তখন আরএসপি’র দোর্দণ্ডপ্রতাপ। গণনাকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন দলের ওই এলাকার প্রতিষ্ঠাতা ননী ভট্টাচার্য। ধুতির কোঁচা গুঁজতে গুঁজতে দলীয় কর্মীদের পরামর্শ দিচ্ছিলেন, ‘জিতিলেও উচ্ছ্বসিত হইবে না, হারিলেও বিষণ্ণ হইবে না।’

এখন ভাবি, হায়, আর কোথায় শুনব এমন সহনশীলতা! ননীবাবু বোঝাচ্ছিলেন, ‘আমরা আমাদের নীতি বুঝিয়েছি। সরকারে এলে কী করব জানিয়েছি। মানুষের যদি সেকথা পছন্দ হয়, তাহলে ভোট ব্যালট বক্সে (তখন ইভিএম যুগ আসেনি) ঢুকে আছে। যদি না জিতি আরও ধৈর্য ধরে মানুষকে বোঝানোর কাজ করে যেতে হবে।’ মালদার দাপুটে নেতা আবু বরকত আতাউর গনি খান চৌধুরীকে বলতে শুনেছি, কংগ্রেসকে মানুষ সারাজীবন ভোট দেবেন, এমন গ্যারান্টি আছে নাকি! ভোটে হারজিত তো আছেই।

গণতন্ত্রের এই সারসত্য এখন কেউ বলে? ননী, গনি খানদের জমানা বদল গয়া। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীদের যুগ। ‘ছিনকে লেঙ্গে’ মানসিকতা। ‘মারি অরি পারি যে কৌশল’-এর যুগ। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় জেলায় ঘুরে দলীয় নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করে বেড়াচ্ছেন, কেউ নিজের এলাকা থেকে তৃণমূল প্রার্থীকে লিড এনে দিতে না পারলে, গর্দান না গেলেও তাঁর পদ যাবে, পরের বার ভোটে আর টিকিট মিলবে না।

ভাবটা এমন যেন নেতারা, জনপ্রতিনিধিরা চাইলেই লিড হাতে চলে আসে! হ্যাঁ, আসেই তো। দিনকতক আগে আলিপুরদুয়ারের বাছাই করা নেতাদের সঙ্গে শিলিগুড়িতে অভিষেকের বৈঠকে কুমারগ্রামের এক নেতা গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে কীভাবে রাতের অন্ধকারে তাঁর ব্লকে দলের জেলা পরিষদ প্রার্থীদের নিশ্চিত হার ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন, তার বিশদ বিবরণ শুনিয়েছিলেন। হার ঠেকানোর এই কৌশল গণতন্ত্রের ব্যাকরণ মানে না।

ব্যাকরণ কী? যেহেতু আমার ছেলেবেলা, যৌবন কেটেছে আলিপুরদুয়ারে, বারবার সেখানকার উদাহরণ চলে আসে। সালটা ১৯৮২। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র পরীক্ষার দিন দোর্দণ্ডপ্রতাপ চা শ্রমিক নেতা আরএসপি দলের গোপাল মৈত্র মহকুমা শাসককে বলেছিলেন, ‘স্ক্রুটিনির দরকার নেই। সবার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করে দিন।’ গোপালবাবুর ব্যাখ্যা ছিল, মানুষ যদি কাউকে বাতিল করে, সেটাই আসল। কারও মনোনয়ন ঠেকালে আর নির্বাচনের দরকার কী!

উপস্থিত অন্য সব দলের নেতারা তাঁর ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছিলেন। এ তো বিশুদ্ধ ব্যাকরণ। প্রথম দফার ভোটের দিন বিশেষ করে কোচবিহারে যা ঘটল, তাতে সেই ব্যাকরণ নেই। জোর যার মুল্লুক তার। খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক প্রতিরোধের ডাক দিলেন। নির্বাচন কমিশনেরও বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো। কমিশন ঠিক করেছে, বুথে তৃণমূলের ‘দলদাস’ পুলিশকে রাখবে না। বুথের সর্বময় কর্তৃত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে। এমনই কর্তৃত্ব যে, মাথাভাঙ্গার একটি বুথে বিভিন্ন দলের পোলিং এজেন্টদেরই বের করে দিয়েছে আধাসেনা।

এতেও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাকরণ নেই। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে হিংসার শেষ নেই। ভোটার আটকে দেওয়া থেকে শুরু করে বিজেপি কর্মীদের মারধর ইত্যাদি নানা অপকর্মে অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে। বেছে বেছে নির্দিষ্ট কিছু বুথকে টার্গেট করে ভোটার আটকে দেওয়া কোচবিহারে তৃণমূলের পুরোনো কৌশল। ভোট দিতে গিয়ে কারও চোখ ফাটল, কোনও রাজনৈতিক কর্মী আক্রান্ত হলেন।

এতে জনমনে ধারণা হয়, এটাই গণতন্ত্রের ব্যাকরণ। যদিও বিকৃত ব্যাকরণ। কিন্তু গণতন্ত্রের সেই বিকৃত সংজ্ঞা নবীন প্রজন্মের মস্তিষ্কে গেড়ে বসে। এখন নেতারাও তাই চান। ফিরে যাই, ননী ভট্টাচার্যের সেই কথায়, যা শুরুতে বলেছি। তিনি বলেছিলেন, দলের কাজ নীতি, রোডম্যাপ বোঝানো। মানুষের তা মনে ধরলে সেই দলকে সমর্থন করবে। এই নীতি, রোডম্যাপ বোঝানোর অন্যতম অস্ত্র দলের নির্বাচনি ইস্তাহার। অথচ দলগুলির কাছে ইস্তাহারের গুরুত্ব এখন কেমন, কয়েকটা ঘটনা বলি।

প্রথম দফা ভোটের আগের দিন বাংলায় বামফ্রন্ট ইস্তাহার প্রকাশ করল। মানুষ পড়বে কবে? তৃণমূলের ইস্তাহার প্রকাশিত হল প্রথম দফা ভোটের দু’দিন আগে। বিজেপির ইস্তাহার সামনে এল ভোটের পাঁচদিন আগে। একসময় দেখতাম, হাজার হাজার ইস্তাহার ছাপিয়ে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামেও বিলি করতেন সব দলের কর্মীরা। এখন আর কোথাও ইস্তাহার দেখি না। দলীয় নেতা-কর্মীরা ইস্তাহারের কথা মুখেও আনেন না। ছুঁয়ে দেখা পরের কথা।

বিমান বসু যেদিন বামফ্রন্টের ইস্তাহার প্রকাশ করলেন কলকাতায়, সেদিন গলায় কাস্তে-হাতুড়ি-তারা আঁকা উত্তরীয় ঝুলিয়ে মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে হাঁটলেন অধীর চৌধুরী। কিন্তু বাম-কংগ্রেস জোটের কোনও ইস্তাহার নেই, রোডম্যাপও কাউকে জানানো হল না। মানুষ কীসের ভিত্তিতে আস্থা রাখবে তাদের ওপর? ইস্তাহার এখন নিয়মরক্ষার বিষয়। এতে আর যাই হোক, গণতন্ত্রের ব্যাকরণ নেই। ব্যাকরণ না মানলে ভাষার শুদ্ধতা থাকে না, গণতন্ত্রের যথার্থ দর্শনটাও হারিয়ে যায়। সব দলই দর্শনটা আড়াল করতে মরিয়া। ব্যাকরণের বিশুদ্ধতা রক্ষায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

0
Weather Report | ঘনাচ্ছে বজ্রগর্ভ মেঘ, কোন কোন জেলায় বৃষ্টি? উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: এই মুহূর্তে চাতক পাখির মতো সাধারণ মানুষ চেয়ে রয়েছেন আকাশের দিকে।...

CV Ananda Bose | রাজভবনে প্রবেশ ‘নিষিদ্ধ’ চন্দ্রিমার, ঢুকতে পারবে না পুলিশও

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রাজভবনে প্রবেশ ‘নিষিদ্ধ’ করা হল রাজ্যের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের (Chandrima Bhattacharya)। রাজভবন চত্বরে পুলিশেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন রাজ্যপাল (Bengal...

Josh Baker | মাত্র ২০-তেই প্রয়াত ব্রিটিশ স্পিনার জশ বেকার

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মাত্র ২০ বছর বয়সেই প্রয়াত ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় স্পিনার জশ বেকার। ওরচেস্টারশায়ার ক্রিকেট ক্লাবের তরফে তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। তাঁর...

Rahul Gandhi | সনিয়ার কেন্দ্র রায়বরেলি থেকে প্রার্থী হচ্ছেন রাহুল

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: জল্পনার অবসান। সোনিয়া গান্ধির (Sonia Gandhi) ছেড়ে যাওয়া আসন উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলি (Raebareli) থেকে লড়বেন রাহুল গান্ধি (Rahul Gandhi)। অন্যদিকে আমেথি...

Drug recovery | স্কুটারের পাদানিতে লুকোনো ছিল সাড়ে তিন কোটির মাদক, যুবককে ধরল পুলিশ

0
ফালাকাটা: মাত্র ১ মাস ১ দিনের ব্যাবধান। ফের বিপুল পরিমান ব্রাউন সুগার জাতীয় নিষিদ্ধ মাদক (Drug recovery) সহ ১ যুবককে গ্রেপ্তার করল ফালাকাটা থানার...

Most Popular