সানি সরকার, শিলিগুড়ি : এখানে একটা পাকা রাস্তা ছিল বটে। লোনাক লেক বিপর্যয়ে ত্রাস হয়ে ওঠা তিস্তা সেই রাস্তার অনেকটাই গিলে খেয়েছে। পিচ ধুয়েমুছে প্রায় সাফ। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পাথরের চাঁই নেমেছে। ফলে এই রাস্তায় গাড়ির চাকা গড়ানোর পথ বন্ধ। জল-কাদা-মাটি মাখা রাস্তাটিতে ঠিকমতো হেঁটে যাওয়াটাও এখন দুঃসাধ্য। আক্ষরিক অর্থেই বাড়িঘরগুলির করুণ দশা। সেগুলিতে এখন ফুটের পর ফুট জমাট পলি। প্রকৃতির তাণ্ডবের সাক্ষী মানুষগুলি গত কয়েকদিনে বহু কেঁদেছেন। কাঁদতে কাঁদতেই তাঁদের চোখের জল শুকিয়েছে। ধ্বংসস্তূপ তিস্তাবাজার গেলে মন খারাপ হতে বাধ্য। মঙ্গলের রাতের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্গাপুজোর আগে বাংলার তিস্তাপাড়ের গ্রামগুলিতে কতটা অমঙ্গলের বান ডেকেছে, তা এখানকার ছবিতেই স্পষ্ট। গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) এই গ্রামগুলিকে চিহ্নিত করে ত্রাণশিবির তৈরি করছে। কিন্তু স্থায়ীভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই কবে মিলবে তা অসহায় মানুষগুলির জানা নেই।
মঙ্গলবার মাঝরাত থেকে ভয়াল হয়ে তিস্তা শুধু সিকিমেই নয়, বাংলার একের পর এক গ্রাম গিলেছে। একের পর এক রাস্তা তার গর্ভে। গেইলখোলা থেকে যতদূর চোখ যায়, ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের কোনও অস্তিত্ব নেই। তিস্তাবাজার থেকেও একই ছবি। সিকিমের লাইফলাইন কবে সম্পূর্ণভাবে প্রাণ ফিরে পাবে, তা ঘোর অনিশ্চয়তায়। মেল্লি-রংপো এবং রংপো-সিংতাম রুট খুলে যাওয়ায় কালিম্পং থেকে গ্যাংটকের যোগাযোগ নতুন করে তৈরি হয়েছে। দার্জিলিংয়ের জোড়বাংলো থেকে পেশক হয়ে গ্যামন সেতু পেরিয়ে তিস্তাবাজারে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তিস্তাবাজার ও সংলগ্ন গ্রামগুলির রাস্তা কবে প্রাণ পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোথাও রাস্তার অস্তিত্ব নেই। বর্ষা বিদায়ের বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত গ্রামে পা রাখা দায়। যে কোনও সময় পা পিছলে যেতে পারে। তিস্তাবাজার রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ফুলমতি তামাং বললেন, ‘তিস্তার জল এখনও আটকে আছে। তার মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। কয়েকদিন টানা রোদ না উঠলে গ্রামে ঢোকা যাবে না।’
কিন্তু গ্রামে গিয়ে থাকবেন কোথায়? রুটিরুজির কী হবে? খাবেন কী? এমন প্রশ্ন এখন এখানকার মানুষদের কুরে-কুরে খাচ্ছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন বা এলাকা পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত জিটিএ অবশ্য ত্রাণশিবির চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিস্তাবাজারের ত্রাণশিবিরের দায়িত্বে থাকা জিটিএ টুরিজমের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর সোনম ভুটিয়া বলেন, ‘রাজ্য সরকার এবং জিটিএ সবরকমভাবে দুর্গতদের পাশে আছে। তাঁদের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তা করা হচ্ছে।’ কিন্তু দিনের পর দিন নিজের বাড়ির বাইরে থাকতে কার ভালো লাগে, প্রশ্ন দেবিকা ছেত্রী, পলাশ দেওয়ানদের। জিটিএ’র ত্রাণশিবিরটিতে ১০৩টি পরিবারের সদস্যরা ঠাঁই নিয়েছেন।
শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের আট সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল রবিবার তিস্তাবাজারে ত্রাণ পৌঁছে দেয়। দলের অন্যতম সদস্য দেবাশিস চক্রবর্তী বললেন, ‘মনে হচ্ছে কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রয়েছি। চারদিকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। বাড়িগুলি পলি চাপা পড়েছে, জলকাদায় রাস্তায় চলা দায়। মানুষগুলির দিকে তাকানো যাচ্ছে না।’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জ্যোতির্ময় পালের বক্তব্য, ‘এমন গ্রামগুলিকে চিহ্নিত করে নিয়মিত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ চিকিৎসক সঞ্জয় সরকারও এদিন প্রতিনিধিদলটির সঙ্গে তিস্তাবাজারে পৌঁছেছিলেন। তিনি বেশ কিছু মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের তরফে বাসিন্দাদের হাতে কম্বল, মশারি তুলে দেওয়া হয়। ফের সুদিন ফিরবে। দেবিকা, পলাশরা এখন সময় গুনছেন।