উত্তর সম্পাদকীয়

সবার আগে থিয়েটারে অভিনয় করাটা জরুরি

  • খরাজ মুখোপাধ্যায়

বলিউডে যাঁরা অলটারনেটিভ অভিনেতা যেমন মনোজ বাজপেয়ী, পরেশ রাওয়াল বা এখনকার পঙ্কজ ত্রিপাঠী, সঞ্জয় মিশ্র, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, এঁদের নিজস্ব আইডেন্টিটি হচ্ছে অভিনেতা হিসেবে। স্টার হিসেবে নয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বোদ্ধারা জানেন যে, এঁরা ভালো অভিনেতা। বাংলায়ও বোধকরি সেই কাজটা হতে চলেছে। কারণ একটা সময় ছিল চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, বুম্বাদা, অভিষেকদা, এঁরাই নায়ক। ওদিকে, উত্তমবাবুর সময়ে উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন, উত্তমকুমার-সুপ্রিয়া দেবী, বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা রায় নায়ক-নায়িকা এবং তার সাপোর্টিভ হিসেবে আরও আরও অন্য অভিনেতারা এসেছেন। কিন্তু এখন বোধহয় একটা টার্নিং পয়েন্ট আসছে। একজন ক্যারেক্টার আর্টিস্টকে দিয়ে লাঞ্চবক্স করানো যায়, এটা দেখে ভালো লাগছে। আমি তো মনোজ বাজপেয়ীকে হিরো বলতে পারব না, কিন্তু তাঁকে দিয়ে ফ্যামিলি ম্যান করানো যায়। এই যে ভাবনায় কিছুটা হলেও বদল এসেছে, তার জন্য আমরা প্রচণ্ড আশাবাদী। কারণ পরিচালকরা শুধু হিরো নয়, অভিনেতাদের ওপর ভরসা করছেন। এখন ওয়েব সিরিজগুলোতেও সেই চেষ্টা আমরা লক্ষ করছি, সাফল্যও মিলছে। ফলে সব মিলিয়ে আশাবাদী।

এখন দক্ষিণী বহু ছবিতে আমাদের পূর্বাঞ্চলের অনেক শিল্পী কাজ করছেন। তাঁদের নিয়ে বেশ ভালো ভালো কাজও হচ্ছে। বড় বড় কাজ করছেন তাঁরা, তাই আমি আশাবাদী। যদি আমার ক্রেডেনলের কথা হয়, তাহলে বলব টালিগঞ্জ থেকে আমিই সবচেয়ে বেশি হিন্দি ছবি করেছি। না, এটা কোনও মহত্ত্বপূর্ণ কথা নয়। কিন্তু যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, যে সমস্ত ডিরেক্টরদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাদের মুনশিয়ানা, যে সমস্ত ডিওপি-রা কাজ করেছেন আশপাশে, তাদের দক্ষতা, কেমন করে কাজটা করছেন, কী করছেন, কী ধরনের পার্থক্য, সেটা বুঝতে পেরেছি। দেখেছি, একটা সামান্য জিনিসকেও তাঁরা সুন্দর থেকে সুন্দরতর করে তোলার জন্য কীভাবে প্রাণপাত করছেন। অবশ্যই বাজেট একটা বড় ফ্যাক্টর। কিন্তু তাঁদের এই প্রাণপাত করার যে মানসিকতা বা ধরন, তাকে ক্যাজুয়ালি না নিয়ে সেটাকে বাস্তবায়িত করা, এটা কিন্তু শেখার বিষয়।

ধরা যাক, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর কথা। তাঁকে ‘কহানি’ ছবিতে যে চরিত্রটা দেওয়া হয়েছিল, সেই চরিত্রে কি তাঁকে মানিয়ে যায়? না, কোনও ভাবেই নয়। তাহলে, কেন তাঁকে চরিত্রটিতে অভিনয়ের জন্য মনোনীত করা হল! আসলে, তাঁকে পোর্ট্রে করা হয়েছে। এমনভাবে পোর্ট্রে করা হয়েছে, যে দর্শক ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন চরিত্রটি ঠিকই আছে। এই যে ‘কনভিংসিংলি’ পোর্ট্রে করে দেখানো হয়েছে, তার ফলেই চরিত্রটির নিজস্বতা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। আমি এমন পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছি, যেখানে আমি বুঝতে পারছি, এই দৃশ্যটাই আমার করে দেখাবার, তখন উনি ক্যামেরাটা আমার মাথার পিছনে রেখেছেন, কী করব! আফটার অল, একজন পরিচালক। প্রতিটি বিষয়ের একটা মান্যতা আছে, ফলে আমার পক্ষে বিষয়টা নিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। একটা প্রোটোকল আছে। আমি কাজ করতে গিয়েছি, সেখানে পরিচালকের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। আমাকে মেনে নিতেই হয়।

একজন পরিচালক অভিনেতাকে যেভাবে ব্যবহার করতে চাইছেন, তিনি কিন্তু সেভাবেই ব্যবহার করবেন। যদি তিনি ভালোভাবে ব্যবহার করতে জানেন, তাহলে কোনও ব্যাপার নয়। আর যদি তিনি ব্যবহার করতে না জানেন, তাহলে তিনি নষ্ট করছেন। আর নষ্টের পরিমাণটাই বেশি। যত দিন যাচ্ছে, কাজ না জানার সংখ্যাটাই বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু থিয়েটারের থার্ড বেল যদি বেজে যায়, তখন কিন্তু আর সেটা ডিরেক্টরস মিডিয়া থাকে না। সেটা পুরোপুরি তখন অভিনেতাদের অভিনয়ের মঞ্চ। তখন একজন অভিনেতা কী করবেন, কতটা করবেন, সবটাই তাঁর উপর নির্ভর করে। এখনকার নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তাই বলি, থিয়েটারে অভিনয় করার জন্য। থিয়েটার থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। প্রথমত, অভিনেতার সর্বাঙ্গ, তাঁর সারা শরীরটা অভিনয় করে যতক্ষণ তিনি অভিনয় করেন। দুই, অভিনেতা যখন রিহার্সাল রুমে থাকেন, তখন হয়তো তিনি একটাই চরিত্র করছেন, কিন্তু রিহার্সাল রুমে যখন আছেন তখন আরও দশটা চরিত্র তাঁর মধ্যে তৈরি হচ্ছে, প্রতিনিয়ত। সব মিলিয়ে দশখানা চরিত্রে তিনি তৈরি হচ্ছেন, নিজেকে তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছেন, যদিও অভিনয় করছেন একটি মাত্র চরিত্রে। এত বড় শিক্ষা সিনেমা-সিরিয়ালে দুম করে পাওয়া যায় না। এটা একমাত্র থিয়েটারই আপনাকে দিতে পারে।

অভিনয়ের জন্য শহরে থাকতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে প্রবলভাবে বেঁচে আছে আমার গ্রাম। বেঁচে আছে বলেই অভিনয়ের জগতে সামান্য হলেও জায়গা করতে পেরেছি। সে কিছুতেই শহুরে সভ্যতার ভড়ংয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে চায় না। সে আজও চায় মাটিতে পা থাকুক, মাথাটা আকাশে চলে যাক, অসুবিধে নেই।

রান্না বিষয়টা আমার কাছে বেশ পছন্দের। সুযোগ পেলে প্রায় প্রতিদিন রান্না করি। যখন শুটিংয়ে যাই তখনও মনে হয়, রান্নাটা করতে পারলে ভালো হয়। আমার কাছে এই রান্নার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আসলে যাদের সঙ্গে থাকি বা যাদের সাহচর্যে থাকি, তাদের কাছ থেকে আমার এগিয়ে যাওয়ার মতো কিছু উৎসাহব্যঞ্জক কিছু পাই না। অকারণ কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ কি! চতুর্দিকে প্রচুর হিপোক্রিসি দেখতে পাই। তাদের কথা আমাকে নাড়া দেয় না, আমার অন্তরে ভিতর ঘরে কোনও সাড়া পাই না। তাহলে এদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করা কেন? তা না করে, যে বিষয়ে আমি অনেক বেশি মনোযোগ দিতে পারব, সেই কাজই করা ভালো। তারা আমাকে যদি সাহায্যও যদি না করতে পারে ক্ষতি নেই, কিন্তু আমাকে অন্য পথে অন্য মতে ঘুরিয়ে দেবে, পথভ্রষ্ট করবে, সেটা কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই এমন কিছু করি, যাতে আমার মনোযোগ প্রয়োজন হয়। নিজের ভিতরের তাগিদ থেকে যে কাজ করতে ইচ্ছে করে, সেই কাজই করি। সে রান্না করাই হোক অথবা ফুল গাছে জল দেওয়া, বেড়াতে যাওয়া হোক বা সাঁতার কাটা, মাছ ধরা বা মাছের ঝোল, যে কোনও ভাবেই যে যেটা পারে, সে সেটা নিজের মতো করুক। আমি রান্না করতে পারি, সেটাই করি। এটাও ঠিক, আমি রান্না করতে করতে সৃজনশীল কাজের কথা ভাবি। সেই ভাবনাটা আমার মাথায় আসে। সত্যি বলতে, রান্না করাটা আমার কাছে অনেকটা মেডিটেশনের মতো।

এই প্রসঙ্গে আমার ছেলে বিহুর উদাহরণ টানতেই হয়। সে ছোটবেলা থেকে ভীষণরকম তালপ্রবণ। যেসব কথা বলত, সেটাকে কিছুক্ষণের মধ্যে ও তালে নিয়ে চলে যেত। এখন ওর ওটাই পেশা। ধরা যাক, ও বায়না করছে, বাবা চিড়িয়াখানায় যাব, সেটাও কিছুক্ষণ পর ও তাল দিয়ে দিয়ে বলত। যেটা নিয়ে পড়ত, সেটা নিয়েও এরকম করত। আমার স্ত্রী প্রতিভা হয়তো রান্না করছে, সামনেই ডাইনিং টেবিল। প্রতিভা চিতল মাছের মুইঠা তৈরি করছে মাছটা সেদ্ধ করে, আলু দিয়ে মেখে মুঠো করে পাকিয়ে গোল্লা করে। তো, বিহু ওখানে যাচ্ছে, একটা করে তুলছে টপাং করে খাচ্ছে। এর মাঝেই তাল দিয়ে চিতল মাছের মুইঠা, চিতল মাছের মুইঠা বলতে শুরু করল। আমি এই রান্না নিয়েও অনেক রকমের গান লিখেছি। সবাই ভাবে, খরাজ মানেই মজার গান, তা নয় কিন্তু। সিরিয়াস গানও আছে। কিন্তু ওই গানটা আমি সবথেকে কম সময়ে ডাইনিং টেবিলে বসে লিখেছি। ‘চিতল মাছের মুইঠা, গরম ভাতে দুইটা, হায় বাঙালি হায়’ গানটা।

আমার এই রান্না নিয়ে আমি এতটাই সিরিয়াস হয়ে গিয়েছি, সেটা প্রথম বুঝতে পারি যখন ঊষা উত্থুপ তাঁর জন্য একটা গান লেখার আমন্ত্রণ জানালেন, তখন। যেটা নাকি রান্নাকেন্দ্রিক হবে এবং কে বলছেন, ঊষা উত্থুপ। সেই গানের বিষয় হবে, আপনি একজন দক্ষিণ ভারতীয়, আপনি আমাদের বাঙালি রান্নাবান্নার কী বুঝবেন মশাই? আপনি নিরামিষ খান। তখন আমি চ্যালেঞ্জটা নিয়ে বলব, আমি এই সব রান্না জানি। তুমি কী খাবে বলো, আমি সব তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি রান্না করে। এই নিয়ে গান লেখার অনুরোধ। সেই প্রথম লিখলাম গানটা। লেখার পর ঊষাজি বললেন, ‘এটা কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে ডুয়েট গাইছেন’। এত বড় সম্মান আমার প্রত্যাশার বাইরে।

বিজ্ঞাপনে কত গান করেছি, ইয়ত্তা নেই। হালকা চালে ভাবতে ভাবতে, জিনিসটার মধ্যে পারফেকশন আনতে আনতে লেখালেখির ক্ষেত্র ছেড়েও বলব, ‘পাতালঘর’ ছবিতে গান করে বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, কিশোরকুমার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি আর মঞ্চে গান গেয়ে মানুষের ভালোবাসা তো পেয়েইছি। আমি কিন্তু কোনও সারেগামাপা-র মঞ্চ থেকে আসিনি, আমার শেখাটা সবটাই রাখালের মতো। সে যেমন বাঁশি বাজাতে পারে, জানেই না, এটা সা না রে, না গা, কিন্তু শুনতে এত ভালো লাগে! আমার গানও এসেছে সেভাবেই। যতদিন একজন শিল্পী বেঁচে থাকবে, সে তার সৃজনশীলতার মধ্যে থাকবে। যেদিন তার সৃজনশীলতা শেষ হয়ে যাবে, সেদিন শিল্পী প্রাণে বেঁচে থাকলেও সে আসলে মৃত বলে প্রমাণিত হবে। আমার নাটকে ডায়ালগ ছিল, আমরা তো দু’-দু’বার মরি না। কারণ কোনও শিল্পী তার নিজের কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না। একটি কাজ সে একবারই করবে। সেটা নিয়ে যদি চর্বিত চর্বন করে, তাহলে সেখানেই তার শেষ। যা করবে, নতুন করবে।

সৃষ্টি যদি থেমে যায়, তাহলে শিল্পী নামে বেঁচেবর্তে থাকলেও শিল্পীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এই শিক্ষাটা সকলের জন্যই।

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Mithun Chakraborty | মোদির থেকে মেসেজের উত্তর পেতে কতক্ষণের অপেক্ষা? উত্তর দিলেন মিঠুন

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, তাঁকে পাঠানো মেসেজের উত্তরও…

6 hours ago

CV Ananda Bose | ‘দিদিগিরি সহ্য করব না’, কলকাতায় ফিরেই মমতার রাজনীতিকে ‘নোংরা’ তকমা দিলেন রাজ্যপাল

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা অভিযোগের পালটা জবাবে কড়া ভাষায় আক্রমণ করলেন…

8 hours ago

Elephant | চা বাগানের জলাধারে পড়ল শাবক সহ মা হাতি, তিন ঘণ্টার অপারেশন শেষে উদ্ধার

জলপাইগুড়ি: বীরপাড়ার মাকড়াপাড়া চা বাগানের গভীর জলাধারে পড়ে যাওয়া মা হাতি ও হস্তিশাবককে দীর্ঘ তিন…

8 hours ago

Leopard Attack | চিতাবাঘের হামলায় জখম তরুণ, আতঙ্ক এলাকায়

ময়নাগুড়ি: দিনদুপুরে চিতাবাঘের হামলায় (Leopard Attack) জখম হল বছর ২০-র এক তরুণ। ঘটনাটি ঘটেছে ময়নাগুড়ি…

8 hours ago

Lok Sabha Election | মঙ্গলে মালদার দুই কেন্দ্রে ভোট, অশান্তি রুখতে তৎপর কমিশন

মালদা ও চাঁচল: তৃতীয় দফায় মঙ্গলবার মালদার দুই লোকসভা কেন্দ্রে ভোট। নির্বাচনি অশান্তি এড়াতে তৎপর…

8 hours ago

CISCE Result 2024 | আইএসসিতে দার্জিলিং জেলায় সম্ভাব্য প্রথম দেবপমা

শিলিগুড়ি: সিআইএসসিই(CISCE Result 2024) পরিচালিত দ্বাদশ শ্রেণির আইএসসি(ISC) পরীক্ষায় দার্জিলিং জেলায় সম্ভাব্য প্রথম মাটিগাড়া সেন্ট…

9 hours ago

This website uses cookies.