মণিপুরে উত্তরবঙ্গ সংবাদ-১
রূপায়ণ ভট্টাচার্য, ইম্ফল : মসৃণ রাস্তাটা ইম্ফল থেকে মিজোরামের রাজধানী আইজলের দিকে যাচ্ছে সটান। ডানদিকে সবুজ পাহাড়ের মাথার ওপর মেঘেদের মেলায় বিশেষ অতিথি রোদ্দুর। জাতীয় সড়ক থেকে ঘন বিস্তীর্ণ সবুজ ধানখেত চলে গিয়েছে পাহাড়ের হাত ধরতে। মাঝে মাঝে শুধু কাকতাড়ুয়ার মূর্তি। যেন বাংলাই।
এমন চূড়ান্ত রোমান্টিক আবহের মধ্যে হঠাৎ জাতীয় সড়কের মধ্যে নানা ধরনের ব্যারিকেডের বিস্তার শুরু। টায়ার, পাথর, বালির বস্তা, তারকাঁটা, বাঁশ। সেনাবাহিনীর বড় বড় গাড়ি। তখন এগোনো দায়।
জাতীয় সড়ক ধরে গেলে প্রথমে পড়ে বিষ্ণুপুর। চোখে পড়ে, পথে নানা এলাকায় মেইতেই নারীরা বসে আছেন চাঁদোয়ার নীচে। মাঝে মুসলিমপ্রধান অঞ্চল কোয়াকতা। পাহাড় কাছে আসতে থাকে। আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতির মোইরাং শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ঢোকে চূড়াচাঁদপুর জেলায়। এটা আবার একেবারে কুকিদের ডেরা। সেখানে জাতীয় পতাকা রাস্তায় লাগিয়ে বসেন মহিলারা। যাতে একজন মেইতেইও রাস্তা দিয়ে না যান।
এ পথে পাহাড়ের দিকে থাকতেন কুকিরা, উলটো দিকে মেইতেইরা। থাকতেন, আর থাকেন না। আজ রাস্তার দু’দিকে সমস্ত বাড়ি জনশূন্য। কোনও বাড়ি ভাঙা, কোনওটা পোড়া, কোনও বাড়ির উড়ে যাওয়া বারান্দায় বালির বস্তার বাংকার। খোলা দরজা, জানলার মাঝে লতাপাতা মেলেছে কোনও গাছ। তোরবুং নামের গ্রামে দেখলাম, পোস্ট অফিস, থানার পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে।
বাফারজোনে সেনাবাহিনীর লোকেরাও সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। অচেনা সাংবাদিকের সামনেও অফিসার প্রশ্ন করে ফেলেন, ‘কবে সমস্যা মিটবে, ধারণা দিতে পারেন? কিছুই তো হচ্ছে না। কেন্দ্র কিছু বলছে না। তিন মাসের বেশি হয়ে গেল আমরা এখানে পড়ে। জানি না, কতদিন এখানে থাকতে হবে।’
তাঁর পরের কথাটাই আসল। ‘এটা জাতিগত দাঙ্গা নয়, রীতিমতো যুদ্ধ।’ মাথার ওপরে তখন চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার। সেনার গলায় অধৈর্যের ছাপ। এই জনহীন গণ্ডগ্রামে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, অসমের এঁরা দিন কাটাচ্ছেন কারও পরিত্যক্ত বাড়িতে। ‘ক্যায়া করু, ইয়ে তো নোকরি হ্যায়’ হতাশাও বাসা বেঁধেছে। কেন্দ্রের নীরবতায় হতাশা বাড়ছে মেইতেইদেরও। সোমবারই মোদি-শা’র কুশপুতুল পোড়াচ্ছেন মেইতেইরা, এমন ছবি ভাইরাল হয়েছে। ক’দিন আগে যা ভাবাই যেত না বীরেন সিংয়ের পদ্ম-রাজ্যে।
চূড়াচাঁদপুরের পথে মিলিটারির জিজ্ঞাসাবাদের সামান্য পরে সেনার পোশাকে এসে এক তরুণ পরিচয়পত্র দেখাতে বলেন। অত্যন্ত শীতল গলা। ড্রাইভার নীচু গলায় বললেন, ছেলেটি কুকিদের পাহারাদার। মেইতেইরা যেন ওদিকে যেতে না পারেন, তার জন্য সদা সতর্ক। উলটো দৃশ্য দেখা যাবে চূড়াচাঁদপুর থেকে ইম্ফল ফেরার সময়। হঠাৎ গাড়ির মধ্যে উঁকি দেবেন মেইতেই নিরাপত্তারক্ষী। কুকিরা কেউ ঢুকে পড়ছেন না তো? ড্রাইভার মুসলিম সম্প্রদায়ের হলে তাঁকে ছাড়। এমন কোনও লোক না থাকলে যাতায়াত করা অসম্ভব। একদিনের মধ্যে বোঝা যায়, সিআরপিএফ কোনওপক্ষকেই চটাতে নারাজ।
মণিপুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠে যায় পরের দৃশ্যমালায়। যখন চূড়াচাঁদপুরের থেকে আসা পুলিশের গাড়িকে থামায় মিলিটারি। ইম্ফলের দিকে যেতে দেবে না পুলিশকে। গাড়ি ঘুরিয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো চলে যায় পুলিশ। দুটো তথ্য শুনলাম যাতায়াতের পথে। এক, প্রায় প্রতিদিনই ঝামেলা চলছে পুলিশ ও মিলিটারির। দুই, পুলিশের মধ্যেও পরিষ্কার দুটো ভাগ মণিপুরে। একদল কুকি সমর্থক, একদল মেইতেইদের।
পাহাড়ি শহর চূড়াচাঁদপুরে হাত ধরে আরেক ঝাঁক বিস্ময়। বাজারের অধিকাংশ দোকানে জায়গাটার নাম কেটে লেখা হয়েছে, লামকা। কুকি ছাত্র নেতা জেরির সঙ্গে দেখা সেখানে। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘চূড়াচাঁদপুর একজন মেইতেইয়ের নামে। আমরা ওটা আর মেনে নেব না। তাই শহরের অন্য নাম দিয়েছি। ওই নাম আমরা চালু করে দিয়েছি।’
সত্যিই তাই। পুলিশ স্টেশনের নীচেও কালো কালিতে চূড়াচন্দ্রপুর নামটা কালি দিয়ে কেটে লেখা হয়েছে লামকা। ‘লামকা’ মানে কুকি ভাষায় মিলনমেলা। অনেক পুরোনো নাম। চূড়াচন্দ্র মণিপুরের প্রাক্তন মেইতেই রাজা। কুকিরা তাঁর নামের শহরে থাকতে চাইবেন কেন? দাবিটা অনেকদিনের। এখন তা প্রবলতর। রাস্তার ধারে শ-খানেক কালো কফিন রাখা। স্মৃতির দেওয়াল বানিয়ে সব মৃত কুকিদের ছবি টাঙানো। বোর্ডে নিয়মিত পালটানো হচ্ছে মৃত-আহতের সংখ্যা। কুকিরা এসে পালন করছেন নীরবতা।
রবিবারই ইম্ফলের কাগজে গুরুত্ব দিয়ে বেরিয়েছে স্থানীয় মুসলিম বিধায়ক নুরুল হাসানের মন্তব্য। নয়াদিল্লিতে অমিত শা’র সঙ্গে দেখা করে এসে মেইতেইদের সভায় নুরুল দাবি করেছেন, মণিপুরকে কোনও মতেই দু’ভাগ করা হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কাগজগুলোয় গুরুত্ব দিয়ে খবরটা ছাপা দেখে একটা জিনিস স্পষ্ট, রাজ্যভাগের দাবি কতটা প্রবলভাবে উঠছে। কুকি জনতার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, তারা আরও একটি রাজ্যের দাবি সহজে ছাড়বে না। মেইতেইদের মণিপুরে থাকতে তারা নারাজ।
কলকাতা থেকে ইম্ফলের ছোট্ট বিমান রওনা হওয়ার সময় চোখে এল অর্ধেক আসনই ফাঁকা। প্রথম চোদ্দো আসনের মাত্র তিনটেতে যাত্রী। অধিকাংশ যাত্রীর মুখে হাসি নেই। একই দৃশ্য চোখে পড়ে ইম্ফল বিমানবন্দরে নেমে। প্রচুর যাত্রী অপেক্ষারত, শব্দহীন। মণিপুরের লোক না হলে আপনার মনে হবে, বিদেশে এসেছেন। ইনার লাইন পারমিট চাই- আপনাকে ফর্ম ফিলআপ করতে হবে অভিবাসনের ঢঙে। এক মাসের বেশি থাকতে দেওয়া হবে না। একশো টাকা দিতে হবে পারমিট পেতে।
বিমানবন্দর থেকে নেমে বড় রাস্তায় পড়লে আরও নিস্তব্ধতা গ্রাস করে। রবিবার কার্ফিউ চলছিল। পরপর দোকান বন্ধ। খোলা বলতে শুধু ওষুধের দোকান। লোকে হাঁটছে। গাড়ি চলছে। কিন্তু দোকান বন্ধ। হোটেলের সামনে জটলায় মণিপুরি বৃদ্ধের মন্তব্য, ‘রাজ্যের অর্থনীতি এই তিন মাসে একেবারে শেষ। ব্যবসাপত্র সব লাটে উঠেছে।’
সোমবার দুপুর বারোটা পর্যন্ত কার্ফিউ ওঠায় রাস্তায় পুরোনো জ্যাম। মেয়েদের বিশ্বখ্যাত বাজার ইমা কেইথেলে আবার ব্যস্ততা। দুপুর থেকে যথারীতি চেনা শূন্যতা। তারই মাঝে প্রবল গরমে মোড়ে মোড়ে মেইতেই নারীদের প্রতীকী অবস্থান। ‘কুকিদের সাথী’ আসাম রাইফেলসের কাজের প্রতিবাদে, শান্তির দাবিতে।
নিস্তব্ধতার শ্মশানে শান্তি আনবে কারা? নাগাদের পাহাড়ি শহর তামিলনং যাওয়ার পথে পড়ে কাংচুপ গ্রাম। সেখানে পথে মাঝে মাঝে মেইতেই মহিলারা লাঠি হাতে বসেন। কিছু জায়গায় বালির বস্তার বাংকার। বৃদ্ধা থেকে তরুণী, সবাই হাজির। শুনসান রাস্তা। যথারীতি কথা নেই। শুধু নজর যাতে কুকিরা না ঢোকেন। লাগোয়া ধানখেতে চাষে ব্যস্ত কিছু মহিলা। পথে এঁরা পালা করে পাহারায়। এরা সবাই সেই বহু আলোচিত নারী বিপ্লবী দল ‘মেইরা পাইবিস’-এর অংশ। ভাঙা হিন্দি, ইংরেজিতে তাঁদের মূল প্রশ্ন, কুকিরা এত আধুনিক অস্ত্র পাচ্ছেন কোথায়? কুকিদের মতো এঁদেরও স্লোগানহীন অবস্থান দেখে ভাবি, বাঙালিরা এটা পারবেন?
চূড়াচাঁদপুরের কাছে বুয়ালজাং গ্রামে কুকিদের অবস্থান শিবিরে কথা হল চং হই হাওকিপের সঙ্গে। একটু এগোলেই ১৯১৭ সালের ইংরেজ-কুকি যুদ্ধের শতবর্ষ উদযাপনের গেট। এই অঞ্চলেই মে মাসের শুরুতে কুকিদের ওপর প্রথম আক্রমণ চালিয়েছিলেন মেইতেইরা। সে কথা জানিয়ে হাওকিপ সপ্রতিভ ইংরেজিতে বোঝাচ্ছিলেন, ‘আমাদের এদিকটা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। খাবার আসছে না। ওষুধ আসছে না। ইন্টারনেট বন্ধ। ফোন সমস্যা। গাড়ি বন্ধ। আমাদের এখানে কারও বড় অসুখ হলে আর ইম্ফল যেতে পারি না। উলটোদিকে মিজোরামের আইজলে যেতে হচ্ছে। মেইতেইদের কিন্তু কোনও সমস্যা নেই।’
ইম্ফল কার্যত কুকি শূন্য। প্রথমদিকে তাঁরা মার খেয়েছেন বেশি। সবাই তখন পালিয়েছেন চূড়াচাঁদপুরের দিকে। ভিনরাজ্য থেকে আসতে হলে ইম্ফল হয়ে আসার সুযোগ নেই। নামতে হবে মিজোরামে। এসব অবিশ্বাস্য ঘৃণার কাহিনীর মাঝে রাজধানীর পথে এখনও অমিত শা’র বিশাল হোর্ডিং ঝুলছে। ৬৮ দিন আগে যখন এসেছিলেন ইম্ফলে, তখনকার। কোনওটা ছিঁড়ে গিয়েছে। কোনওটা আবছা। ছবিতে বড় করে লেখা- ‘আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই মণিপুরে।’ শানিত বিদ্রুপের মতো শোনাচ্ছে কথাগুলো।