সৌরভ দেব, জলপাইগুড়ি: বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা। মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকার কিস্তি মেটাতে হয়। কৃষক পরিবারের তরুণের দাবি, সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতেই তিনি শিক্ষকতার চাকরিটা পেয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনিও একটি স্কুলের শিক্ষিকা। আদালতের রায়ে দুজনেই বর্তমানে ‘চাকরিহারা’দের তালিকায়। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ওষুধ থেকে শুরু করে ব্যাংকের ঋণের বোঝা কীভাবে মেটাবেন সেই চিন্তাতেই শিক্ষক দম্পতির রাতের ঘুম উড়েছে। এ শুধু একজন বা একটি দম্পতির কথাই নয়, আদালতের রায়ের পর বিপাকে পড়া অনেকের ক্ষেত্রেই একই ছবি।
সমস্যা মেটাতে আইনি পথে লড়াই করতে জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri) জেলার চাকরিহারাদের একাংশ একজোট হয়েছেন। বৃহস্পতিবার জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় ২০০ জন জলপাইগুড়ি রাজবাড়িদিঘি প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছিলেন। চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকরা জানিয়েছেন, কলকাতায় তাঁদের মতো যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, ইতিমধ্যে তাঁরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। খুব শীঘ্রই এই যোগ্য প্রার্থীরা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মামলা চালাবার খরচ বহন করার জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে মামলার জন্য এই চাকরিহারাদের থেকে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ হচ্ছে। মামলার জন্য যোগ্যদের ওকালতনামাতেও সই করানো হচ্ছে। এদিন চাকরিহারাদের একজন বলেন, ‘জেলার প্রায় দেড় হাজার যোগ্যের চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে এদিন আমরা একত্রিত হয়েছি। এই বিষয়ে কলকাতায় আমাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা হয়েছে।’
জলপাইগুড়ি শহরের বাসিন্দা চাকরি হারানো এক শিক্ষক দম্পতির সঙ্গে এদিন রাজবাড়িদিঘি প্রাঙ্গণে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, ওই শিক্ষক ফালাকাটার প্রত্যন্ত গ্রামের এক কৃষক পরিবারের সন্তান। মামার বাড়িতে থেকে তাঁর পড়াশোনা। সরকারি চাকরি পাওয়ার আগে কিছুদিন বিন্নাগুড়ির একটি মিশনারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ২০১৯ সালে নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর সদর ব্লকের একটি স্কুলে তিনি ভৌতবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হন। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, তাঁর স্ত্রী একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ। সংশ্লিষ্ট বছর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় তাঁর নাম ছিল। তিনি বর্তমানে ধূপগুড়ি ব্লকের একটি স্কুলের শিক্ষিকা। জলপাইগুড়িতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকলেও জমি কিনে নিজেদের একটা বাড়ি তৈরির জন্য দম্পতি ঋণ নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার পর তাঁদের কার্যত মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। কীভাবে সংসার চলবে আর তাঁরা কীভাবে ঋণের বোঝা টানবেন তা ভেবে দুজনে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছেন না।ওই শিক্ষক বললেন, ‘আমরা দুজনেই ভালো পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেয়েছিলাম। কিন্তু অযোগ্যদের সঙ্গে আমাদের মিলিয়ে ফেলা হল। সকলের সঙ্গে একজোট হয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করব। কিন্তু জানি না আগামীতে কী হবে! খুবই বিপদে রয়েছি। বৃদ্ধ বাবা–মা খুব টেনশন করছেন।’
ধূপগুড়ি এলাকার অপর এক চাকরিহারা শিক্ষিকার সঙ্গে এদিন রাজবাড়িতে কথা হচ্ছিল। তিনি অঙ্কে স্নাতকোত্তর। ওই শিক্ষিকা বললেন, ‘কোনও রাজনৈতিক দল করি না। কোনও নেতাকে ধরেও চাকরি পাইনি। পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করে চাকরিটা পেয়েছি। অথচ এখন জানতে পারছি যারা সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছিল তাদের সঙ্গে আমাদের মতো যোগ্যদের মিলিয়ে ফেলা হল। কার দোষে এমনটা হল সেই বিতর্কে জেতে চাই না। যোগ্যদের মর্যাদা দিয়ে তাঁদের চাকরি বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।’