শুভঙ্কর চক্রবর্তী, জলপাইগুড়ি: ১৮৭৬ সালে গজলডোবায় জলপাইগুড়ি জেলার প্রথম চা বাগানটি তৈরি হয়েছিল। সেই সময় জলপাইগুড়ির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু। বাঙালি উদ্যোগপতিদের চা ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং বাগানের জন্য জমির লিজ ব্যবস্থা চালুতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন ভগবানচন্দ্র।
১৪৮ বছর আগের সেই চারাগাছ পরবর্তীতে বটবৃক্ষ হয়ে জলপাইগুড়িকে চায়ের উপনিবেশ বানিয়েছে। চায়ের শহর হিসাবে গোটা পৃথিবীতে পরিচিতি পেয়েছে জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri)। সরকারি আমলা হিসাবে দেড়শো বছর আগে জেলার উন্নয়নে ভগবানচন্দ্র যতটা উদ্যোগী হয়েছিলেন তেমন উদ্যোগ কি পরবর্তীতে জেলার জনপ্রতিনিধিদের তরফে দেখা গিয়েছিল?
ভোট এলেই প্রশ্নগুলো ওঠে। যেমনটা উঠেছে জয়ন্ত রায়ের (Jayanta Roy) ক্ষেত্রে। জয়ন্ত বিজেপির (BJP) সাংসদ। কেন্দ্রে তাঁদের দল ক্ষমতায়। ফলে নিজের দক্ষতায় কেন্দ্রীয় প্রকল্প এনে জেলার উন্নয়নে নজির গড়বেন, জয়ন্তর প্রতি সেই ভরসা রেখেছিলেন জেলাবাসী। পুরোপুরি ভরসাযোগ্য হয়ে ওঠার মতো কাজ তিনি করে দেখাতে পারেননি। তবে ভরসা যে একেবারে উবে গিয়েছে তাও কিন্তু নয়। পারফরমেন্সের বিচারে জয়ন্ত মাঝামাঝি জায়গায় আছেন।
জলপাইগুড়ির না পাওয়ার যন্ত্রণা অনেক। বন্ধ চা নিলামকেন্দ্র দগদগে ঘায়ের মতো সেই যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোটে জিতলে নিলামকেন্দ্র খোলা হবে- ২০১৯-এ বিজেপির তরফে সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ বছরেও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি সাংসদ। তেঁতুলিয়া করিডর নিয়েও আশার কথা শুনিয়েছিলেন। করিডর খোলেনি।
জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রকে টি-টিম্বার-ট্যুরিজমের আদর্শ এলাকা বলা হয়। তিনটির কোনও বিষয়েই পাঁচ বছরে দাগ কাটতে পারেননি জয়ন্ত। অন্য এলাকার কথা বাদ দিন, জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া বন্ধ রায়পুর চা বাগানে অপুষ্টিতে শ্রমিক মৃত্যুর পরও তাঁদের দুর্দশা ঘোচাতে জেলায় কেন্দ্রের আলো ফেলতেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
‘ও তোমরা গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে’ – প্রতিমা বড়ুয়ার গলায় এই গান শোনেননি, উত্তরবঙ্গে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। মঙ্গলবার ভোট প্রচারে জয়ন্তকে দেখে গানের সুরেই প্রশ্ন তুলেছেন মেখলিগঞ্জের ভোটারদের একাংশ। জলপাইগুড়ি লোকসভা এলাকায় থাকা কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমাতে জয়ন্তকে বলা হয় ‘ডুমুরের ফুল’। সব মহলেরই অভিযোগ, ভোটে জেতার পর না তিনি এলাকায় গিয়েছেন, না উন্নয়নের কাজ করেছেন। শুধু মেখলিগঞ্জ নয়, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বা শিলিগুড়ি শহরের মধ্যে ঢুকে থাকা জলপাইগুড়ির মানুষজনও গত পাঁচ বছর সাংসদকে এলাকায় দেখেননি।
সাংসদ তহবিলের অর্থ খরচের নিরিখেও পিছনের সারিতেই জয়ন্তর নাম। তাঁর বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগ এখনও খরচ হয়নি। অর্থাৎ রাস্তা, নর্দমা তৈরি, হাইমাস্ট আলোর ব্যবস্থা এইসব টুকটাক কাজেও পিছিয়ে রয়েছেন জলপাইগুড়ির সাংসদ।
এটা ঠিক যে, ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার মতো তেমন কোনও প্রকল্প জেলায় আনতে পারেননি জয়ন্ত। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর চেষ্টার খামতি ছিল না। জন বারলা বা নিশীথ প্রামাণিকের মতো মাঠে-ঘাটে প্রতিশ্রুতির লম্বা ফর্দ হাতে ঘুরে বেড়াননি তিনি। বহু সমস্যা চিহ্নিত করে প্রচারের আড়ালে থেকে নিজের মতো করে কাজ করেছেন।
ব্রহ্মপুত্র নদীবোর্ডের বরাদ্দের কথাই ধরা যাক। রাজ্যের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, বোর্ডের সদস্য রাজ্য হলেও এক টাকা বরাদ্দ মেলে না। সেটা জেনে নিজের উদ্যোগে নথিপত্র জোগাড় করে জয়ন্ত দিল্লিতে দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। একটি প্রতিনিধিদলও নিয়ে এসেছিলেন জেলায়। যদিও কেন্দ্র-রাজ্যের রেষারেষির রাজনীতির কারণে রাজ্যের সেচকর্তারা কেন্দ্রীয় দলের সঙ্গে দেখাই করেননি। ফলে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
তৃণমূল নেতারা অস্বীকার করলেও জলপাইগুড়ি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন বা সার্কিট বেঞ্চের কেন্দ্রীয় বরাদ্দ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সাংসদ জয়ন্তর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। করলা অ্যাকশন প্ল্যান নিয়েও কেন্দ্রীয় নদী কমিশনে বারবার তদ্বির করেছেন তিনি। বহু সমস্যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কোভিডের সময়ও নিজেকে ঘরবন্দি রাখেননি জয়ন্ত। প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছেন বিভিন্ন এলাকায়।
আবার দলের ভেতরে ও বাইরে হাজারো বিরোধিতা, শক্তিশালী শিলিগুড়ি লবির সঙ্গে লড়াই করেও দার্জিলিং মেলকে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে হলদিবাড়িতে নিয়ে যেতে সফল হয়েছেন জয়ন্ত। জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনকে পদাতিকের স্টপও পাইয়ে দিয়েছেন। সাংসদ হিসাবে তাঁর দুই সাফল্য জলপাইগুড়ি মনে রাখবে।
লোকসভার ভেতরেও জয়ন্তর পারফরমেন্স বেশ উজ্জ্বল। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস-এর রিপোর্ট বলছে, লোকসভা অধিবেশনের মোট ২৭৩ দিনের মধ্যে জলপাইগুড়ির সাংসদ উপস্থিত ছিলেন ২৩৯ দিন (৮৭.৫%)। প্রশ্ন করেছেন ৪৩৫টি।
পারফরমেন্সে সেভাবে ছাপ ফেলতে না পারলেও জয়ন্তর কাজ করার চেষ্টা, ভদ্রতা, সাধারণ জীবনযাপন তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।