শমিদীপ দত্ত, শিলিগুড়ি : একপাশে তিস্তার চর, আর একপাশে মহানন্দা অভয়ারণ্য। মাঝখান দিযে কাঁচা মাটির রাস্তা। রযেছে গুটিকয়েক কাঠের বাড়িঘর। ডাবগ্রাম-১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার অন্তর্গত অন্য গ্রামগুলি যখন মনোনয়নের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পতাকা, ফেস্টুনে সাজতে শুরু করেছে, তখন চমকডাঙ্গি-লালটং বনবস্তি একেবারেই নিরুত্তাপ। পঞ্চায়েত ভোট নিযে বাড়তি উৎসাহ তো দূর, কোনও কথাই নেই বনবস্তির বাসিন্দাদের মুখে। ‘কথা হবেই বা কেন?’, পালটা প্রশ্ন করে বসলেন স্থানীয় বাসিন্দা অজয় তামাং। আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বললেন, ‘সমাজ তো ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত করে নিযেছে কে পঞ্চায়েত সদস্য হবেন। তাহলে বাড়তি ভাবার তো কিছু নেই।’
শিলিগুড়ি শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে ঘেরা এই বনবস্তি। বস্তিতে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে আলাদা করে মাতামাতি হয় না। বস্তির প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি সমাজই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, এক্ষেত্রেও রযেছে পরিবারতন্ত্র। সমাজের মাথায় রয়েছেন ইন্দিরা বাহাদুর ছেত্রী। বর্তমানে ইন্দিরার বয়স হওয়ায় সমাজের মাথায় এখন তাঁর ছেলে গৌতম ছেত্রী। ‘নবজ্যোতি সমাজ’ নামের ওই সমাজের প্রতিনিধি রযেছেন আরও কয়েকজন।
এঁদের তৈরি ‘সমাজ’ সবাই মানেন কেন? স্থানীয় ভানু প্রাথমিক পাঠশালার প্রধান শিক্ষিকা নিরকুমার সুনিয়ার বক্তব্য, ‘ওঁরা দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এলাকার বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। তাই তাঁদের কথা সবাই মেনে নেন।’ কী কাজ করে এই সমাজ? বনবস্তির বাসিন্দারাই জানালেন, এলাকায় কোনও ঝামেলা থেকে শুরু করে অপরাধমূলক কাজ, সব ধরনের সমস্যা সমাধানই করেন গৌতমরা। এমনকি তাঁদের তৈরি ওই ‘নবজ্যেতি সমাজ’-এর অধীনে আরেকটি ‘সমাজ’ রয়েছে। বিয়ের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব আবার ওই সমাজের। গৌতম বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘এলাকায় কোনও ঝামেলা হলে আমরাই মিটিযে দিই। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়রা নিজেরাই মিটিয়ে নেন। বিযের অনুষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল আমরাই দিয়ে থাকি।’
ডাবগ্রাম-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের এই দুই বনবস্তিতে সবমিলিয়ে বাসিন্দার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০০। দুই বনবস্তিতে একটি বুথ রযেছে। ২০১৩ পর্যন্ত এই বুথে প্রার্থী বলতে শুধু ছিল সিপিএম। এবারে অবশ্য সিপিএমের কোনও প্রার্থীই নেই। নির্বাচনে ওই বুথের প্রার্থী বলতে শুধুমাত্র তৃণমূলের ডোমা শেরপা। এবার এই আসন তপশিলি উপজাতি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
আপনারা প্রার্থী দিলেন না কেন? ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভার দায়িত্বে থাকা সিপিএমের দিলীপ সিং স্বীকার করে নিলেন, ‘ওই এলাকায় সমাজই বড় ভূমিকা পালন করে। আগে আমাদের সরকারের সময় ওই সমাজ আমাদের সমর্থন করত। এখন তৃণমূলের।’ গৌতমের জবাব, ‘বাম সরকারের আমলে এলাকার উন্নয়ন হয়েছে। তবে এলাকার আরও উন্নয়নের স্বার্থে সরকারে থাকা দলের সঙ্গে থাকাই ভালো।’ তাঁর আরও যুক্তি, ‘একাধিক প্রার্থী দাঁড়ালে উন্নয়ন নষ্ট হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে এলাকার থেকে একজনকে পঞ্চায়েত সদস্য হিসেবে দাঁড় করাই।’ তবে গতবারের ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবশ্য এই ট্রেন্ডের কিছুটা পরিবর্তন হযেছিল। তৃণমূল থেকে সেবার গৌতমদের প্রস্তাব দেওয়া হযেছিল, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পদটি তপশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে সমাজ কোনও এসসি প্রার্থী দিলে তাঁকে প্রধান করা হবে। গৌতম বলছিলেন, ‘প্রধানের মতো কাউকে এলাকা থেকে না পাওয়ায় সেবার তৃণমূল বাইরে থেকে প্রার্থী দিয়েছিল।’ সুযোগ বুঝে বাইরে থেকে প্রার্থী দিযেছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও সিপিএম-ও। যদিও শেষকথা বলেছে সমাজই।
স্থানীয় বাসিন্দা অশোক থাপার কথায়, ‘এলাকার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ইতিহাসে সেবারই আমরা প্রথমবারের জন্য ভোট দিয়েছিলাম। তবে সেটা সমাজের কথামতোই।’ ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ মিলবে কি এখানকার বাসিন্দাদের? জানা নেই কারও। এসবের মধ্যেই কোথাও সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে না তো? ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুধা সিংহ চট্টোপাধ্যাযের কথায়, ‘ওখানে সমাজই তো সব ঠিক করে দেয়।’