প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: পাঁচ দিবসীয় সফরে বুধবার রাতে ওয়াশিংটন ডিসি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ ভারতীয় সময় অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাতে মার্কিন সেনেটে ভাষণ রাখবেন তিনি৷ অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুপস্থিতিতে আগামী ২৪ জুন মণিপুর ইস্যু নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছে কেন্দ্রীয় সরকার, যার পৌরোহিত্য করবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা৷ এসবের মাঝেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিকে মাথায় রেখে শুক্রবার পাটনা ‘সংবাদ ভবনে’ মুখোমুখি বৈঠকে বসছে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শিবির৷ সূত্রের খবর, বিরোধী বৈঠকের অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে আলোচ্যসূচিতে ঠাঁই পেতে চলেছে মণিপুর ইস্যু৷ মণিপুর ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ান্ত উদাসীনতা এবং প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে পাটনার বৈঠকে ঝড় তুলতে, আস্তিন গোটাতে পারেন বিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব৷
বিরোধী শিবির সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবারের বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানের সমালোচনা করে একটি সর্বসম্মতভাবে রেজলিউশন পাস করা হতে পারে, যেখানে বিরোধী শিবিরের তরফে এক বিশেষ প্রতিনিধি দলকে মণিপুরে পাঠানোর প্রস্তাবও রাখা হতে পারে বলে দাবি বিরোধী দলীয় সূত্রে।
প্রসঙ্গত, মণিপুর ইস্যুতে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বিরোধী নেতা-নেত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম মে মাসের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা’কে চিঠি লিখে মণিপুরের উপদ্রুত অঞ্চলে সফরের অনুমতি প্রার্থনা করেন৷ কিন্তু মমতার সে আর্জি নাকচ করে কেন্দ্রীয় সরকার৷ স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেত্রী, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে শুক্রবারের বিরোধী বৈঠকে মণিপুর ইস্যুতে সোচ্চার হতে পারেন এবং মণিপুরে বিরোধী প্রতিনিধি দল পাঠানোর প্রস্তাব দিতে পারেন বলে বিরোধী শিবির সূত্রে দাবি করা হয়েছে৷ এরই মাঝে মণিপুর ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকা সর্বদল বৈঠকের সাফল্য নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহলে৷ বৃহস্পতিবার কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি টুইট করে বলেন, ‘গত ৫০ দিন ধরে জ্বলছে মণিপুর, অথচ প্রধানমন্ত্রী নিরুত্তর৷ সর্বদলীয় বৈঠক তখনই ডাকা হল যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেশে নেই৷ এর থেকে প্রমাণিত হয়, প্রধানমন্ত্রী এই বৈঠককে গুরুত্ব দিতে নারাজ৷’
এর আগে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি মণিপুর ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে টুইটে বলেছিলেন, ‘মণিপুরে জাতি হিংসার আবহে হারিয়ে গিয়েছে ১০০-র বেশি প্রাণ, ৬০,০০০-র বেশি মানুষ হয়েছেন আশ্রয়হীন৷ অথচ কেন্দ্রীয় সরকার এই সংকট নিয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন৷’ কংগ্রেসের তরফে অতীতে বারবার মণিপুর ইস্যুতে রাজধর্ম পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানানো হয়৷ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, বর্ষীয়ান সাংসদ জয়রাম রমেশ বারংবার মণিপুর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেন৷ কংগ্রেস সংসদীয় দলনেত্রী সনিয়া গান্ধি বুধবার রাতে বিবৃতি জারি করে মণিপুর সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, একইসঙ্গে রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷ এর পরেও বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মোদি সরকার গোটা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ৷ এই কারণেই প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সর্বদল বৈঠক ডাকা হয়েছে৷ এই আবহে শুক্রবার পাটনার বৈঠকে মণিপুর ইস্যুতে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিরোধী শিবির সেদিকেই চোখ রাখছে রাজনৈতিক মহল৷
গত ৫০ দিনের বেশি সময় ধরে রীতিমতো অগ্নিগর্ভ মণিপুর। এখনও যেখানে হিংসা থামার কোনও লক্ষণ নেই৷ বেসরকারি হিসেবে মণিপুরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে এখনও পর্যন্ত শতাধিক নিহত, হাজারের বেশি লোক আহত এবং লক্ষাধিক লোক গৃহহীন৷ এই সংকট মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার সঠিকভাবে রাজ্যের হাল ধরেনি এমনই অভিযোগ বিরোধী শিবিরের৷ তাত্পর্যপূর্ণভাবে মণিপুরের হাল হকিকত তুলে ধরতে রাজ্যের তিনটি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা দিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন৷ এরপরেই ক্ষোভ বেড়েছে বিরোধীদের৷ তাঁদের অভিযোগ, হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করেই নীরব থেকেছেন, এমনকি মণিপুরের কোনও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতও করেননি৷ সরকারের শীর্ষ স্তরের সাড়া না পেয়ে মণিপুরের বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা কংগ্রেস, আপ, সিপিএম, সিপিআই নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাত করে দিল্লি ছাড়েন৷ বিরোধীদের আরও অভিযোগ, অতীতে জাতীয় সুরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী মোদি বারবারই বিরোধীদের এড়িয়ে গিয়েছেন৷ গালওয়ানের চিনা সংঘর্ষ ইস্যু ছাড়া তাঁকে ডোকলাম, অরুণাচল, কাশ্মীর, রাফাল, আদানি প্রতারণার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিরোধীদের মুখোমুখি হতে দেখা যায়নি৷ এই বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকারের শীর্ষ স্তরের তরফে মণিপুর ইস্যুতে এমন একটা সময়ে সর্বদল বৈঠক ডাকা হয়েছে যখন প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে ব্যস্ত৷ ফলত কেন্দ্রীয় অবস্থান নিয়ে ক্রমশ প্রবল ক্ষোভ মাথাচাড়া দিচ্ছে বিরোধীদের একাংশে। শুক্রবারের বিরোধী দলীয় বৈঠকে মণিপুর ইস্যুতে কী ব্যতিক্রমী অবস্থান নেয় সমমনোভাবাপন্ন বিরোধী শিবির, তাই এখন দেখার অপেক্ষা।