প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: মণিপুর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদে উপস্থিত হয়ে উভয়কক্ষে বিবৃতি পেশ না করলে বিরোধী জোটের সম্মিলিত আন্দোলন এবং বিক্ষোভের মুখে বাদল অধিবেশনের কাজ ভণ্ডুল হতে পারে। এমনই আশঙ্কা ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে সংসদীয় পরিসরে। বৃহস্পতিবার দিল্লিতে সংসদীয় বাদল অধিবেশনের প্রথমদিনই মণিপুর ইস্যুতে যে অগ্ন্যুৎগারের সাক্ষী রইলো সংসদ ভবন, তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমশ প্রকট হয়েছে শাসকদলীয় শিবিরের। এ অবস্থায় সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণভাবে সংসদ পরিচালন করতে কী সুচারু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় মহলে।
মণিপুরে জাতি সংঘর্ষ নিয়ে এমনিতেই উত্তপ্ত কেন্দ্রীয় রাজনীতি। সেই আবহে অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে মণিপুরে বিবস্ত্র মহিলাদের সেই ভিডিও। যদিও ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি উত্তরবঙ্গ সংবাদ। এদিকে ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই গোটা দেশে ক্ষোভের আগুন ছড়ায়। প্রত্যাশিতভাবেই তার আঁচ এসে পড়ে সংসদেও।
বাদল অধিবেশনের সূচনায় এই ঘটনায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘এই কদর্য ঘটনা ১৪০ কোটি দেশবাসীর লজ্জা। মহিলাদের ওপর হওয়া এই অত্যাচার কোনওভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। আইন কড়া হাতে বিষয়টি দেখবে। অভিযুক্তদের দ্রুত চিহ্নিত করে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হবে।’ তাৎপর্যপূর্ণভাবে মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে প্রথমবার প্রকাশ্যে মুখ খুললেন মোদি।
যদিও মোদির এই বক্তব্যকে নিতান্তই ‘কুম্ভিরাশ্রু’ বলে মনে করছেন ‘ইন্ডিয়া’র শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা বিরোধী সদস্যরা৷ তাঁদের বক্তব্য, মণিপুর নিয়ে সময় থাকতে সরকার পদক্ষেপ নিলে, এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। এখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার সেই মর্মেই রণকৌশল নির্ধারণ করতে সংসদে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা তথা দলীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের কক্ষে সকাল-সকাল আলোচনায় বসেন ২০টি বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা। আলোচনায় স্থির হয়, খোদ প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের উভয়কক্ষে উপস্থিত হয়ে মণিপুর নিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে হবে ও বক্তব্য রাখতে হবে। এর বিকল্প কোনও পন্থায় হাঁটতে নারাজ বিরোধীরা, অন্যথায় ভণ্ডুল করা হবে বাদল অধিবেশন৷
একইসঙ্গে বিরোধীদের দাবি, নাতিদীর্ঘ নয় মণিপুর নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলাপ আলোচনা দরকার সংসদে। সংসদীয় আইনের ২৬৭ ধারায় মুলতুবি প্রস্তাবই বিরোধীদের কাছে শ্রেয়৷ মণিপুর নিয়ে সরকারের তরফে সদর্থক বার্তা এলে তবেই অধিবেশনের অবশিষ্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো, বেকারত্ব, নারী নিগ্রহ (তপসিলি জাতি উপজাতি ও সংখ্যালঘু সমাজ অন্তর্ভুক্ত), রেল সুরক্ষা এবং মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ক ইস্যুতে আলোচনা করবে বিরোধীরা, নচেত নয়।
মণিপুর ইস্যুতে কতটা বিক্ষুব্ধ, ক্রোধান্বিত এবং আগ্রাসী হয়ে আছে বিরোধী শিবির, তার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখা গেল সংসদের উভয়কক্ষেই। এদিন লোকসভায় হাজির হয়ে, অধিবেশন শুরুর প্রাক মুহূর্তে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে বিরোধী শিবিরের দিকে এগিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ সে সময়ে কংগ্রেস বেঞ্চে উপস্থিত কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেত্রী সনিয়া গান্ধির প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে নমস্কার করে তাঁর শারীরিক কুশলতার কথা প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলে, সংসদীয় সূত্রে জানা যায় সনিয়া সরাসরি বলেন, ‘শরীর ঠিকই আছে, কিন্তু মণিপুর ঠিক নেই। তা নিয়ে দ্রুত আলোচনা চাই। আমরা চাই আপনিও থাকুন এই আলোচনা পর্বে।’ সনিয়া গান্ধির কাছ থেকে পাওয়া এমন অভাবনীয় প্রস্তাবে রীতিমতো চমকে যান মোদি৷ ‘দেখা যাক’ বলে এগিয়ে যান তিনি। সনিয়া সহ বিরোধী শিবিরের শরীরি ভাষ্যে বোঝা গিয়েছিল, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা৷ তা-ই লোকসভায় ‘অবিচুয়ারি’ পাঠের পরপরই সভার কাজ তড়িঘড়ি দুপুর ২টা পর্যন্ত স্থগিত রাখতে দুবার ভাবেননি অধ্যক্ষ ওম বিড়লা৷ দুটোর পরে সভার কাজ পুনরায় শুরু হলে প্রবল হইচই বাঁধিয়ে ‘ওয়েলে’ নেমে আসেন বিরোধীরা। সংসদীয় কার্যনির্বাহী মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী বলে ওঠেন, ‘সরকার মণিপুর নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত। বিরোধীরা সহযোগিতা করলেই তা শুরু করা যায়৷ কিন্তু সংসদ ভণ্ডুল করে কোনও মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।’ কিন্তু বিরোধীরা তাতে কর্ণপাত করেননি। শুরু হয় ব্যাপক হইচই। বাধ্য হয়ে লোকসভার কাজ সারাদিনের জন্য মুলতুবি রাখেন স্পিকার প্যানেল কিরিটভাই সোলাঙ্কি। এই প্রসঙ্গে কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘মণিপুর ইস্যুতে সরকার ভীত, সন্ত্রস্ত। তাই ঘন ঘন মুলতুবি করে পিঠ বাঁচাতে চাইছে। আমাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ সরকার এই ইস্যুতে যতক্ষণ না আলোচনা করছে, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পথ ছাড়বে না বিরোধীরা।’ বলে রাখা জরুরি, মণিপুর নিয়ে সংসদে জরুরি আলোচনার দাবিতে উভয়কক্ষেই এক ডজনের বেশি বিরোধী সাংসদেরা এদিন মুলতুবি প্রস্তাব আনেন।
মণিপুর নিয়ে প্রবল উত্তপ্ত হয় রাজ্যসভাও। এদিন বিরোধী শিবিরের তরফে প্রায় ১৫ জন সাংসদ মণিপুর নিয়ে জরুরি চর্চার দাবি তুলে রাজ্যসভায় মুলতুবি প্রস্তাব দেন। রাজ্যসভায় শুরু হয় ব্যাপক হইচই, বিশৃঙ্খলা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সভার কাজ সারাদিনের জন্য মুলতুবি করতে বাধ্য হন রাজ্যসভা অধ্যক্ষ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুর এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘মণিপুরে যা হয়েছে তা নিন্দনীয়, অমার্জনীয়। সরকার তার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু বিরোধীরা মণিপুরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করছেন।’ একই সুর শোনা গেছে প্রাক্তন আইনমন্ত্রী এবং বর্ষীয়ান বিজেপি সাংসদ রবিশঙ্কর প্রসাদের কণ্ঠেও। রবিশঙ্কর বলেন, ‘মণিপুরে যা হয়েছে তা মর্মান্তিক। কোনও ভাষাতেই এর নিন্দা যথেষ্ট নয়। সরকার সাধ্যমতো পরিস্থিতি শুধরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিরোধী নেতারা তা নিয়ে নিম্নমানের রাজনীতি করছেন।’
মণিপুর ইস্যুতে উদ্বিগ্ন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সংসদে বিরোধী রণকৌশলের কথা অনুধাবন করে তাঁরা দুজনেই দলের একান্ত অনুগত বর্ষীয়ান সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনকে ২১ জুলাই ‘শহিদ দিবসে’র বদলে দিল্লিতে সংসদেই থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।