গাজোলঃ শনিবার সকালে ভিডিও কলে শেষ কথা হয়েছিল স্বামীর সঙ্গে। কোলের ছেলেকে নিয়ে তখন তিনি ছিলেন বাপের বাড়িতে। স্বামী বলেছিলেন সে যেন শ্বশুর বাড়ি চলে আসে। কয়েকদিন পরে ফিরবেন তিনিও। রোজা রাখবেন। তারপর বাড়ির সবাই মিলে খুব আনন্দ করবেন ইদ। স্বামীর কথা শুনে সেদিনই চলে আসেন শ্বশুরবাড়িতে। এখানে এসে সেদিনই পেলেন দুঃসংবাদ। তারপর থেকেই শোকে পাথর আসমিরা। গতকাল রাতে চেন্নাই থেকে আকাশপথে স্বামীর কফিনবন্দি দেহ এসে পৌঁছেছিল দমদম বিমানবন্দরে। সেখান থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে এদিন সকালবেলা দেহ এসে পৌঁছেছিল গ্রামে। দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায় অন্তেষ্টিক্রিয়া। তারপর থেকে পাড়ার মহিলারা আগলে রেখেছেন আসমিরাকে।
মালদা জেলায় পরিযায়ী শ্রমিকের মৃতের নামের তালিকায় সংযোজিত হল আরও একটি নাম। তামিলনাড়ুতে কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলেন গাজোলের সাহাজাদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চেরাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মিনসারুল ইসলাম (২৫)। পরিবারের জন্য দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করতে বছর ছয়েক ধরে ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। ছোট জামাইবাবু জিন্নাত হোসেনের সঙ্গেই ওখানে কাজ করতেন। শেষবার কাজে গিয়েছিলেন মাসখানেক আগে। ইচ্ছে ছিল ইদের আগে বেশ কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে ফিরে আসবেন বাড়িতে। তারপর ভালোভাবে পালন করবেন ইদ। রোজা শুরু হওয়ার আগে ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু কফিনবন্দি হয়ে।
মিনসারুল এর বাবা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানালেন, জমি জায়গা তেমন কিছু নেই। এলাকাতেও কাজ নেই। তাই বাবা-ছেলে দুজনই ভিন রাজ্যের শ্রমিকের কাজ করতেন। মাস কয়েক আগে স্ত্রী মারা গিয়েছে। বর্তমানে বাড়িতে ছিলেন তিনি তার এক অবিবাহিতা কন্যা সাবিনা পারভীন (২৮), ছেলে মিনসারুল, পুত্রবধূ আসমা এবং মাস সাতেক বয়সের নাতি-আরিজ ইসলাম। কিছুদিন আগে তিনি কাজ থেকে ফিরেছেন। তারপর গিয়েছিল ছেলে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে রোজা। দিন কয়েকের মধ্যেই ফিরে আসার কথা ছিল ছেলের। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। শনিবার ছাদ ঢালাই এর কাজে নিযুক্ত ছিল ছেলে। ভাইব্রেটার মেশিন চালাতে গিয়ে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হন মিনসারুল। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন বাড়ির মালিকও। উদ্ধার করে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ছেলেকে। সেখানে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। এখন মেয়ের বিয়ে দেব কিভাবে, সংসারই বা কিভাবে চালাব তা বুঝে উঠতে পারছি না। সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি।
ওই গ্রামের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা মালদা জেলা কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি তামিজুদ্দিন আহমেদ বললেন, এলাকায় মানুষের হাতে কাজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছেন তারা। সাহাজাদপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আদিবাসী, মুসলিম, হিন্দু সবমিলিয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। মানুষের হাতে যাতে কাজ থাকে তার জন্য কংগ্রেস জোট সরকার ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প চালু করেছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই কাজে সীমাহীন দুর্নীতি করেছে তৃণমূল। সুযোগ বুঝে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কর্মসংস্থান নিয়ে কোনও কথা নেই দুই সরকারের। কেউ ধর্ম আর জাত পাত, আর কেউ বিভিন্ন ভাতার লোভ দেখিয়ে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছে। আর অন্যদিকে দিনের পর দিন লম্বা হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু মিছিল।
গাজোল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন জানালেন, খুবই দুঃখজনক ঘটনা। খবরটি শোনার পর থেকেই পরিবারের পাশে ছিলেন তিনি। গতকাল রাতে দমদম বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে দেহ পৌঁছে দেওয়ার জন্য পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চায়েত সমিতি এবং ব্লক প্রশাসন ওই শ্রমিকের পরিবারের পাশে রয়েছে। আগামী দিনে কীভাবে ওই পরিবারকে সাহায্য করা যায় তার জন্য সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।