শুভঙ্কর চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার : সুপরিকল্পিতভাবেই লুট হয়েছে আলিপুরদুয়ার ঋণদান মহিলা সমবায় সমিতিতে জমা রাখা গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা। আমানতকারীদের কাছ থেকে তোলা হলেও আদতে সেই টাকা জমা পড়েনি সমিতির কোষাগারে। সমিতির কয়েকজন কর্মী-আধিকারিক সেই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। দুর্নীতি নিয়ে সমবায় দপ্তরের বিশেষ তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এমন নানা তথ্য। আর সেই রিপোর্টই এখন সিবিআই ও ইডি’র অন্যতম অস্ত্র।
আলিপুরদুয়ারের মতো রাজ্যের বহু সমবায় সমিতিতেই যে লাগামহীন দুর্নীতি হয়েছে, তা আঁচ করেই দুর্নীতি রুখতে ‘প্রিভেনশন অফ ফ্রড অ্যান্ড করাপশন কমিটি’ গঠন করল সমবায় দপ্তর। শনিবার কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায়। ডিএসপি পদমর্যাদার একজন আধিকারিক, একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারবিভাগের একজন প্রতিনিধি কমিটিতে থাকবেন। রাজ্যে প্রায় ৪০ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, করাপশন কমিটি ওই সমিতিগুলিতে সারপ্রাইজ ভিজিট করবে। সমিতিতে কোনও অনিয়ম ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তা জানানো হবে রাজ্য সমবায় দপ্তরকে। তারপরই দপ্তর সংশ্লিষ্ট সমিতির বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করবে। করাপশন কমিটি তৈরির পাশাপাশি সমবায় দপ্তরের অডিট বিভাগকে দ্রুত সমস্ত সমবায় সমিতির অডিট শেষ করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
জেলায় জেলায় সমবায় দপ্তরের আধিকারিকরা রয়েছেন। সার্বিকভাবে যাবতীয় কাজকর্ম দেখভালের জন্য রয়েছেন একজন করে অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার অফ কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ (এআরসিএস)। সমিতিগুলিতে তাঁদেরই সারপ্রাইজ ভিজিট করার কথা। কিন্তু তারপরেও দুর্নীতি ঠেকানো যায়নি। ফলে করাপশন কমিটি করে কতটা দুর্নীতি রোধ করা যাবে তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। আলিপুরদুয়ারের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার সদস্যের বিশেষ দল তৈরি করে ঋণদান মহিলা সমবায় সমিতি নিয়ে তদন্ত করেছেন সমবায় কর্তারা।
কী আছে ওই রিপোর্টে? দুর্নীতির জন্য সমিতির ম্যানেজার তৃপ্তিকণা চৌধুরী, অ্যাকাউন্ট্যান্ট রিনা সান্যাল, ক্যাশিয়ার উদিতা দে মাহাতো, অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্লার্ক শম্পা ভট্টাচার্য চৌধুরী, লোন ক্লার্ক সঞ্জীব দাসকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করেছেন তদন্তকারীরা। দুর্নীতির জন্য সমিতির স্পেশাল অফিসার ও পরিচালকমণ্ডলী দায় এড়াতে পারেন না বলেও উল্লেখ করেছেন তাঁরা।
সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৭-’১৮ এবং ২০১৮-’১৯ দুই বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাবই দিতে পারেননি সমিতির কর্তারা। তদন্ত রিপোর্টে মোট দশটি পয়েন্টে কীভাবে দুর্নীতি হয়েছে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তদন্তকারীরা। রিপোর্টের শেষ অংশে তদন্তকারীরা উল্লেখ করেছেন, তাঁরা এমন বহু জমা-খরচের নথি খুঁজে পেয়েছেন যেগুলিতে ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার বা সমিতির কোনও কর্তার স্বাক্ষর নেই। দীর্ঘদিন থেকেই সমিতিতে লাগামহীন দুর্নীতি চলেছে বলেই রিপোর্টের প্রতিটি পাতায় বুঝিয়ে দিয়েছেন তদন্তকারীরা।
তদন্ত রিপোর্টের ৩ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, শেষ অডিট রিপোর্টে সমিতির ২১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৭০২ টাকা বিনিয়োগের কথা বলা হলেও সেই টাকার রেকর্ড সমিতি বা সমবায় ব্যাংকের কোনও নথিতে নেই। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৫-০৭-২০১৭ তারিখে সমিতির লোন ক্লার্ক সঞ্জীব দাস সমিতির কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ লক্ষ টাকা তুলেছিলেন। তবে তার কোনও তথ্য সমিতির কোনও হিসাবের খাতাতেই নেই। বড় অঙ্কের ওই টাকার গরমিলের জন্য সমবায় দপ্তর নিয়োজিত সমিতির তত্কালীন স্পেশাল অফিসারের জবাব দেওয়া উচিত বলেও উল্লেখ করেছেন তদন্তকারীরা।
০৬-০২-২০১৭ সালে রাজ্য সমবায় ব্যাংকের আলিপুরদুয়ার শাখা থেকে সমিতির ৫০ লক্ষ টাকার ক্যাশ সার্টিফিকেট কেনা নিয়েও একাধিক প্রশ্ন তোলা হয়েছে তদন্ত রিপোর্টে। ওই সার্টিফিকেট কেনার জন্য সমিতির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের কোনও নথি পেশ করতে পারেননি ম্যানেজার বা অন্য আধিকারিকরা। অডিট রিপোর্টেই এইসব গরমিল ধরা পড়ার কথা। কেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওইসব গরমিল নজর এড়িয়ে গেল অডিট অফিসারদের তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তদন্তকারীরা। সমিতির একাধিক কর্মী, তাঁদের আত্মীয় ও সদস্য নয় এমন অনেকের নামে বেআইনিভাবে মোটা টাকা ঋণ দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
সমবায় কর্তারা বিষয়গুলি নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। সমবায়মন্ত্রীর কথায়, ‘ইতিমধ্যেই পুলিশ ও সিআইডি তদন্ত করে পদক্ষেপ করেছে। আমরা যেসব পদক্ষেপ করা দরকার তা করছি।’ তৃপ্তিকণা বলেন, ‘আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে আমি যা বলার বলব।’ সমিতির পরিচালন কমিটির চেয়ারম্যান উপাসনা সেনগুপ্তর বক্তব্য, ‘আমাকে অন্ধকারে রেখেই যাবতীয় অনৈতিক কাজকর্ম হয়েছে। সেকথা জানিয়ে পুলিশে অভিযোগও করেছিলাম। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা ডাকলে হাজির হয়ে যা জানি সবটাই বলব।’