দীপ সাহা, নকশালবাড়ি : প্রসাদুজোতের প্রকাণ্ড সেই বট-পাকুড়ের মাঝে নতুন করে মাথা তুলেছে শহিদ বেদি। হঠাৎ ভেসে আসা দখিনা হাওয়ায় দুলে ওঠে জোড়া লাল পতাকা। এই গাছতলাতেই যে একদিন বিপ্লবের আগুন জ্বলেছিল, তা ঠাওর করা মুশকিল। এখন একেবারেই শান্ত।
প্রায় পাঁচ দশক আগে ঠিক এখানেই পুলিশের গুলিতে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। কৃষকের রক্তে ভেসে গিয়েছিল গোটা নকশালবাড়ি। সেই মুহুর্মুহু বন্দুকের গুলি ছোটার আওয়াজ যাঁরা শুনেছিলেন তাঁদের অনেকেই আর নেই। এখন না আছে সেই আন্দোলন, না সেই বন্দুকের আওয়াজ। হঠাৎ ফটাস ফটাস আওয়াজ অবশ্য ভেসে আসে আজকাল। এ আওয়াজ নকশাল বা উর্দিধারী পুলিশের বন্দুকের নয়, কচিকাঁচাদের ফাটানো বাজিপটকার। একটু দূরে থাকা রেললাইনের ধারে কাশফুলের গোছা যেন তখনই ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দেয়, উমা আসছেন এই গ্রামেও।
নকশালবাড়ি বাজার থেকে স্টেশন পেরিয়ে রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে ফুটানি মোড় হয়ে বেঙ্গাইজোত আর প্রসাদুজোতের দিকে। সবুজ ধানখেতের ফাঁকে ফাঁকে এখন উঁকি দেয় বিশাল সমস্ত ইমারত। এই পথেই দেখা অমর-আকবর-অ্যান্টনির সঙ্গে। বয়স মেরেকেটে এগারো কী বারো! একহাতে জ্বলন্ত ধূপকাঠি, আরেক হাতে পটকা। তোদের নাম কী? ওদের একজন বলে উঠল, আমি হিতেন প্রধান, ও মহম্মদ রাজা আর ও অভিজিৎ রায়। তা তোরা এই ভরদুপুরে বাজি ফাটাচ্ছিস কেন? একটু ভয়ে ভয়ে অভিজিতের পালটা প্রশ্ন, ‘পুজো আসছে বলে—কেন এগুলো ফাটানো যায় না?’
ফুটানি মোড়ে ওই রাস্তার পাশেই পলিথিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে সাজানো হচ্ছিল উমাকে। শিল্পীর তুলির টানে একটু একটু করে রাঙা হয়ে উঠছিলেন মা। পঞ্চমীর দুপুরে তখন নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন শিল্পী। খানিক দূরে ক্ষুদিরাম ইউথ ক্লাবের মণ্ডপে কাপড় বাঁধা হচ্ছে তখন। এলাকারই এক প্রবীণ জানালেন, এ গ্রামে হাতেগোনা কয়েকটি পুজো হয়। তাই পাড়ার ছোকরারাই বছর বারো আগে পুজো শুরু করেছে এখানে।
প্রসাদুজোতের কোয়ার্টার মোড়ে বাঁ হাতে চোখে পড়ল ঠাকুরদালান। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গ্রামের মানুষ এই পুজোতেই অংশ নেন বেশি। সেই নকশালদের আমল থেকে পুজো হয়ে আসছে এখানে। পুজোটা শুরু করেছিলেন এলাকার নকশাল নেতা বাণীরাম রায়। তিনি বেঁচে নেই বহুদিন। এখন ছেলে তপন পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নকশাল-ছোঁয়া লেগে থাকা এই পারিবারিক পুজোই এখন হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।
তপন বললেন, আমাদের এই পুজোর বয়স প্রায় ষাট। বাবা নকশাল ছিলেন। কিন্তু পুজো-আচ্ছায় মন ছিল তাঁর। তাই বাড়িতেই কালীপুজো, দুর্গাপুজো হত। তখনও আশপাশে কোনও পুজো হত না। তাই গ্রামের লোক আমাদের পারিবারিক পুজোয় অংশ নিতেন। এখনও তাই। দালানের ঠিক উলটোদিকেই বাড়ি তপনদের। এই বাড়িতেই একসময় রাত কাটিয়েছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নকশাল নেতা মহাদেব মুখার্জি সহ আরও অনেকে। সেই স্মৃতি হাতড়ে বাণীরামের দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী কিরণবালা বললেন, তখন মিটিং করে অনেকে আমাদের বাড়িতে ঘুমোতে আসতেন। সকলের জন্য গুড়, রুটির ব্যবস্থা করতাম।
নকশাল যুগ পেরিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেলও এখনও মনেপ্রাণে অনেকে নকশাল। ফলে পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে নকশাল-আবেগ। আরও কিছু বিশেষত্ব রয়েছে এই পুজোর। যেমন তপনের কথায়, বাবার আমলে একদম শুরু থেকেই নেপালি পুরোহিত পুজো করছেন। মাঝে তিন বছর আমি বাঙালি পুরোহিত দিয়ে পুজো করিয়েছি। কিন্তু এখন আবার সেই নেপালি পুরোহিত দিয়ে পুজো করানো হয়।
হঠাৎ বদল কেন? তপন জানালেন, গত এক দশকে এলাকার জনবিন্যাস পালটে গিয়েছে অনেকটাই। নেপাল, মণিপুর থেকে অনেকেই এখন ঘাঁটি গেড়েছেন নকশালবাড়ি ও খড়িবাড়িতে। আর এই পুজোর সঙ্গে এখন নেপালিরাও জড়িয়ে গিয়েছেন। সন্ধ্যায় আরতি থেকে শুরু করে ভোগ বিতরণ সবেতেই অংশ নেন বিমল প্রধানদের মতো অনেকে। শুধু তাই নয়, পুজোয় চাঁদাও দেন তাঁরা।
দালান, টিনের ছাউনিও তৈরি করে দিয়েছেন বিমল। সারাবছর প্রতিমা থাকে সেখানে। মহালয়ার পর বিসর্জন দেওয়া হয়। আগে ওই জায়গাতেই ত্রিপল টাঙিয়ে পুজো হত শুধু। জাঁকজমক সেরকম না থাকলেও খামতি ছিল না নিয়মনিষ্ঠায়। পুজোর চারদিন ভোগ খাওয়ানো হত পড়শিদের। এখনও তাই হয়। কিরণবালার কথায়, ষষ্ঠীতে আমাদের পুজো শুরু হয়। পুজোর কদিন যাঁরা আসেন তাঁরা প্রসাদ তো খানই, সেইসঙ্গে যদি কারও খিদে পায়, সেজন্য বাড়িতে আলাদা রুটির ব্যবস্থাও থাকে।
নকশাল-হত্যার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বট-পাকুড় গাছের ঠিক উলটোদিকেই থাকেন পানেশ্বরী সিংহ। কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করছেন সেখানে। ৬০ পেরোনো পানেশ্বরী চোখের সামনেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাতে দেখেছেন আন্দোলনকারীদের। তখন তিনি সবেমাত্র ক্লাস ফোরে। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, বাড়ির সামনেই গোলাগুলি হয়েছিল। আমরা পরে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম নেপালে। তিন-চারদিন পর ফিরে এসেছিলাম।
ওই বাড়িতেই ছোট ছেলে, বৌমা, নাতিকে নিয়ে থাকেন পানেশ্বরী। বড় ছেলের আলাদা বাড়ি একটু দূরেই। দিন দুয়ে আগেই পানেশ্বরীর জন্য নতুন শাড়ি নিয়ে এসেছে ছোট ছেলে। পুজোর কটা দিন কীভাবে কাটাবেন? পানেশ্বরী বললেন, এখন আর আগের মতো বাইরে যেতে পারি না। শরীর সঙ্গ দেয় না। আগে তো বাণীরামের বাড়ির পুজোয় যেতাম। ছোট থেকেই ওই পুজো দেখেছি আমরা।
বদলে যাওয়া নকশালবাড়িতে শহুরে ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে কিছু জায়গায়। যেমন নকশালবাড়ি বাজারের কথাই ধরা যায়। সেখানে তো এখন বিগ বাজেটের পুজোর ছড়াছড়ি। পাশাপাশি থাকা সুব্রতি সংঘ ও অগ্রদূত সংঘে পুজো প্রায় শুরু। কথা হচ্ছিল, সুব্রতির পুজো কমিটির সম্পাদক বিরাজ সরকারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এবারে তাঁদের পুজোর ৭২তম বর্ষ। পুজোর সঙ্গে নকশাল যোগ রয়েছে কি না তা অবশ্য জানেন না এ প্রজন্মের বিরাজ কিংবা সোমনাথ দে-রা। তবে, ক্লাবের মাঠে যে একসময় নকশালরা বৈঠক করতেন তা শুনেছেন অনেকের কাছেই।
ওঁদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই দূর থেকে ভেসে আসে পোড়া উৎকট গন্ধ। সেই গন্ধে মিশে কত ব্যবসায়ীর হাহাকার, চোখের জল ও আর্তনাদ। দিন কয়েক আগে সেখানেই যে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে দোকানের পর দোকান। কত মানুষের স্বপ্নও! আবার ওঁরা জেগে উঠছেন নতুন উদ্যম নিয়ে উমা আসছেন বলে। ওঁদের আশা, একদিন সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। উমার কাছে সে প্রার্থনাই করবেন সকলে।