চিরদীপা বিশ্বাস: পুজোর আগে যেন পায়ের তলায় সর্ষে ক্লাস টুয়েলভের ঈশিতার। ‘আর বোলো না দিদি, এ বছর ষষ্ঠীর সকাল পর্যন্ত শুট আছে।’ শুনে খানিকটা থতোমতোই খেয়ে গেলাম, শুট কীসের রে আবার? উত্তর এল, ‘আরে, বিভিন্ন প্যান্ডেলে ঘুরে ফোটো, ভিডিও শুট হবে। আমাদের এখানে আমিই তো মডেল।’
ব্যাপারটা বোধগম্য হলেও হজম হতে খানিকটা সময় লাগল। কারণ নিজের পাড়ার প্যান্ডেলেই একের বেশি সেলফি তুলতে খানিকটা ইতস্তত বোধ করি আমি। সেখানে সাক্ষাৎ দুগ্গা সেজে বিভিন্ন প্যান্ডেলে ঘুরে পোজ দেওয়া, শুট করা-এসব ভাবনাচিন্তাই তো এক মারাত্মক কঠিন কাজ!
ধীরে ধীরে শারদীয়া এবং প্রাক শারদীয়া উদযাপনে বিশাল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে গত কয়েক বছর থেকে। প্রি-ওয়েডিং শুটের অনুকরণে প্রি-দুর্গাপুজোর শুটের বাজারও আজকাল রমরমিয়ে চলছে। বাড়ির খুব কাছেই তোর্ষা নদী। মহালয়ার আগে থেকেই সেখানে ‘জ্যান্ত দুর্গা বিসর্জন’-এর প্রেক্ষাপট রচনা হয় আজকাল। এছাড়াও উত্তরের নানা জেলার আনাচে কানাচে, কাশের বনে, কুমোরটুলিতে বিভিন্ন রূপে মা দুর্গাদের অবাধ যাতায়াত। আবার কখনও দুর্গা সেজে ভিড় রাস্তায় প্র্যাংক ভিডিও শুট বা ট্রেন্ডিং গানে নৃত্যরতা মা দুর্গাকে চাক্ষুষ করার সুযোগ মিলছে।
উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় এধরনের প্রচলন শুরু হয়ে গিয়েছে মহানগরের অনুকরণে। যুগ, প্রজন্মের পরিবর্তনে বদলাচ্ছে বাঙালির আবেগ ও উদযাপনের রীতিনীতি। মহালয়ায় ভোর চারটায় উঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠ আজকের প্রজন্মের ঠিক কজন শোনে? বা ভোর পাঁচটাতে টিভির পর্দায় দুর্গা অসুরের যুদ্ধই বা দেখে ক’জন? এসব নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক ইদানীং নেটমাধ্যমে ঘোরে। অনেকে এমনও মন্তব্য করেন ইউটিউবে চণ্ডীপাঠ অ্যাভেলেবল, ভোর চারটেতেই কেন শুনতে হবে রেডিওতে! যে কোনও সময়ই তো শোনা যায়। আর ওই ওভাররেটেড দুর্গা-অসুর লড়াই তো সারাদিন ধরেই টিভিতে চলতে থাকে। বোরিং যত্তসব!
বড্ড অদ্ভুত লাগে শুনে। এই ধরনের মন্তব্য যারা করে, ঠিক তারাই আবার মহালয়ার আগের রাতে হোয়াটসঅ্যাপে চণ্ডীপাঠের ভিডিও স্ট্যাটাস দিয়ে লেখে মা আসছেন। আর যে শো-গুলোকে ওভাররেটেড লাগে সেগুলোও তো নতুন প্রজন্মের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। তাই দুর্গাকে জমকালো না সাজালে, সিক্সপ্যাক ট্যাটু যুক্ত অসুর না হলে নতুন প্রজন্মই তো বলবে ‘বড্ড ম্যাড়মেড়ে’।
পুজো উপভোগের ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দিনদিন স্পষ্ট। নিজের শহরের, পাড়ার পুজো ছেড়ে অনেকের কাছে ভিনজেলার মহানগরের পুজো চোখ কাড়ে। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণবঙ্গের বড় বড় থিম, বিগ বাজেটের পুজো, ফ্যাশনেবল সাজপোশাক বড্ড বেশি মাতিয়ে তোলে নবপ্রজন্মের অনেককেই। বর্তমানে ট্রেন্ডি ছেলেমেয়েরা অষ্টমী আর থার্টি ফার্স্ট ইভের পার্থক্য বোঝে না। অষ্টমী মানেই সবচেযে সুন্দর এবং অবশ্যই বাঙালি পোশাকে সেজে ওঠা। সে সংজ্ঞা এখন বদলেছে, অষ্টমীর রাতে এখন নবপ্রজন্মের দুর্গাদের ফ্যাশনিস্তা অবতার দেখে চোখ মাথায় উঠে যাওয়ার জোগাড়।
আমাদের প্রজন্মের সঙ্গেই মাত্র বছর পাঁচ-ছয়েক ছোট প্রজন্মের পার্থক্য আকাশপাতাল। তারা যেন অনেক বেশি আধুনিক, প্র্যাকটিকাল, অনেক অ্যাডভান্সড। পুজোর জামাকাপড় কেনাকাটা থেকে শুরু করে মেকআপ, প্যান্ডেল হপিং-সবেতেই তারা বড্ড স্বাধীনমনস্ক। বাজারে ঘুরে ঘুরে শপিং এখন অনেকেরই না-পসন্দ। তার বদলে যান্ত্রিক শপিং নাকি স্যাটিসফাইং। আর মেকআপ! এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেই বেকুব বনে গিয়েছিলাম একবার। ক্লাস নাইনে পড়া আমার এক তুতো বোন তো রীতিমতো বেস মেকআপ, কন্টোরিং, আই মেকআপ- আরও কত কিছু নিয়ে ঘণ্টাখানেক ক্লাস নিয়ে নিল।
নিঃসন্দেহে এখানে শেখার উপকরণ আছে বটে, তা বলে এত ছোট বয়সে কি এটা সত্যিই প্রযোজন? পরীক্ষার সিলেবাস নিয়ে এরা যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত নবমী নাইটের গ্ল্যামারাস পার্টি লুক নিয়ে আমাদের ছোটবেলায় পুজোর মেকআপ আর্টিস্ট বলতে ছিল আমাদের মা। চোখ বন্ধ করে মায়ের হাতযশে সেজে বেরিয়ে পড়তাম ঠাকুর দেখতে, বাবা-মায়ের হাত ধরে। আর এখন… বন্ধুদের বা বিশেষ কোনও বন্ধুর সঙ্গে অষ্টমীর সকালে না বেরোলে মান থাকবে নাকি স্কুল গ্রুপে?
প্রজন্মগুলোর মাঝে আজকাল বড্ড তাড়াতাড়ি মানসিকতার বিরাট পরিবর্তন ঘটছে। স্কুল-কলেজে পড়া বা সদ্য আঠারো উত্তীর্ণ কোনও কিশোরীর সঙ্গে কথা বললে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদেরই নিজেদের সেকেলে লাগে। এমনকি কিছু সমবয়সির সঙ্গে আলাপ হলেও তা মনে হয় বৈকি।
বাঙালিদের কাছে শরৎকাল আবেগ নিয়ে আসে। আগে শরৎ মানেই ছড়া লেখার হিড়িক উঠত সবার মাঝে। পঞ্চমীর সকালে স্কুল ড্রেসের একঘেয়েমি কাটিয়ে গত বছরের সেরা জামা পরে স্কুলে যাওয়া, আর শরৎ বা দুগ্গা মাকে নিয়ে লেখা কার ছড়া ভালো, তা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকা… এই ছিল বছর কয়েক আগের প্রাক পুজো যাপন। এখন যে ক’জন ছুটির আগে শেষ দিন স্কুল যায়, তাদের মধ্যে কম্পিটিশন হয় কে ভালো মেকআপ করতে পারল তা নিয়ে শাড়ি পরে রীতিমতো বিয়েবাড়ির সাজে আজকাল পুজোর ছুটি পালন হয়।
পরিবর্তিত এইসব পরিস্থিতি দেখে অবাক লাগে, বাঙালিয়ানায় ভেজাল মিশতে দেখে খারাপ লাগা ঘিরে ধরে। উত্তরের নিজস্বতা অনুকরণের চাপে হারিয়ে যেতে থাকলে আফসোস হয় ঠিকই, তবে পরক্ষণেই মন বলে ওঠে পরিবর্তনকে মানতেই হবে। মার্কসের কালজয়ী ‘নেতির নেতিকরণ’-এর সূত্র মনে পড়ে বা ডারউইনের ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’। তবে সত্যিই কি আমরা যোগ্যতম হচ্ছি? আধুনিক হয়ে উঠছি ঠিকই, কিন্তু সমাজ গড়ার যোগ্য কারিগর তৈরি করতে পারছি কি? অনুকরণপ্রিয়তাকে দূরে সরিয়ে সাজপোশাক, থিম এসবে কি একটু নিজস্বতা রাখা যায় না? যে প্রজন্ম বি প্র্যাকটিকাল, অত আবেগ নিয়ে ভাবার সময় নেই মন্ত্রে দীক্ষিত করছে নিজেদের ক্রমাগত, তারা ঠিক আর কতটা প্র্যাকটিকাল হলে বুঝবে নিজস্ব সংস্কৃতি, বাঙালির দুর্গাপুজো উদযাপনে পর্যন্ত বেনোজলের প্রবেশ ঘটছে। যে প্রজন্ম ঢাকের বোলে ধুনুচি নাচের পরিবর্তে দশমীর রাতে টলতে টলতে চটকদারি ডিজে গানে কোমর দোলাতে পছন্দ করে, বযস্কদের প্রণাম তো দূর তাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা রাখে না, তাদের আর ঠিক কতটা আধুনিকতা প্রয়োজন উদ্বর্তনের জন্য? উত্তরের প্রান্তিক জেলা থেকে শুরু করে কলকাতা, সর্বত্র এক ছবি।
তবে এসবের মাঝেও নতুন প্রজন্মের এমন অনেকেই আছে যাদের সত্যিই প্রণাম করার ইচ্ছে হয় খুব। কলেজেরই একজন জুনিয়ার বোনকে দেখেছি… সে নিজের উদ্যোগে অর্থসংগ্রহ করে দুঃস্থ পরিবারের মানুষকে পুজোয় নতুন জামা পরার সুযোগ করে দেয়। প্রতিবছর এই কাজের মধ্যেই সে আনন্দ খুঁজে পায়। এভাবেই পুজো উদযাপন করতে ভালোবাসে সে। এরকম অনেক উদাহরণ আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে আছে, তবে তাদের সংখ্যাটা কম হওয়ায় সেসব দেখেও আমরা এড়িযে যাই। সাহায্য না করে বরং সমালোচনায় মুখর হই নিউ জেনারেশন-এর অবদান নিয়ে বর্তমানে আসলে সমালোচকদের সংখ্যা বাড়ছে অথচ সত্যিকারের দুর্গা হয়ে ধীরে ধীরে সামাজিক ক্ষত মেরামতির কাজ করতে চায় যারা তাদের সামান্য সহযোগিতাটুকু আমরা করি না। কিন্তু তাতে দুর্গাদের জীবনীশক্তির অন্ত হয় না বিন্দুমাত্র। সমাজের নেতিবাচক দিকগুলিকে বধ করে গুটিকয়েক নবপ্রজন্মের দশভুজা এভাবেই এগিয়ে যাক আর অনুপ্রাণিত করুক আরও কিছু দুর্গাকে।
(লেখক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুযা, কোচবিহারের বাসিন্দা)