রণবীর দেব অধিকারী: কলকাতা থেকে অপেরা পার্টি এসেছে। রাতে জমিদারবাড়ির চাতালে যাত্রাপালার আসর বসবে। গ্রামের তামাম মানুষ তাই আমোদে আটখানা। নহবতখানায় সানাই বাজছে। রাগ মালকোষের পর সুদূর লখনউ থেকে আসা কোনও শিল্পী ললিত রাগে সুর তুলছেন। শিউলির গন্ধ মাখা ভোরের বাতাসে সেই সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। নুপূর-কঙ্কণের ফিউশন জানান দিচ্ছে অন্দরমহলের রমণীকুলেও চূড়ান্ত ব্যস্ততা। সকাল সকাল স্নান সেরে সকলে লাল পাড় গরদের শাড়ি পরেছেন। ও পাড়া থেকে মহিলারা এসেছেন। দেরাজ থেকে বড় শঙ্খ, ঘণ্টা, রেকাবি, তামার পরাত সহ পুজোর সব বাসন বের করে ধুয়ে রাখা হচ্ছে। রন্ধনশালায় নাড়ু-মুড়কি তৈরির ধুম লেগেছে। গন্ধে ম-ম করছে চারিদিক। বালিকার দল সাজি ভরে শিউলি, টগর আরও কত ফুল তুলে এনেছে। পোড়ো কালী মন্দিরটার সামনে ভাঙা ইটের টুকরোয় হোঁচট খেয়ে সংবিত্ ফিরল। কোথায় জমিদারবাড়ি? এতো ধ্বংসস্তূপ! ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক করুণাকান্ত সরকার চূড়ামণ জমিদারবাড়ির গল্প বলছেন। এখানেই জমিদার জগৎবল্লভ রায় চৌধুরীদের প্রাসাদ ছিল। প্রবল বন্যা আর মহানন্দার ভাঙনে সব ধ্বংস হয়ে যায়। অর্ধেক প্রাসাদ নদীগর্ভে চলে যাওয়ার পর জমিদারদের বড় তরফ ২০ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুরে চলে যান। সেখানে তাঁরা নতুন করে সুদৃশ্য অট্টালিকা তৈরি করেন। ছোট তরফ অবশ্য চূড়ামণেই থেকে যান। তাঁরা নদীর পাড় থেকে সরে এসে বসবাস শুরু করেন। হাতের ইশারায় করুণাবাবু বললেন, আরেকটু এগিয়ে চলুন। কোমর সমান লতাগুল্মের জঙ্গল ভেদ করে কিছুটা এগোতেই বেশ বড় একটা বেদি চোখে পড়ল। প্রবীণ শিক্ষক জানালেন, এটা সেই সময়ে দুর্গা মায়ের থান। ইতিহাসের চিহ্ন হিসেবে এই বেদি আর ভাঙা ইটের ঢিপি এখনও পড়ে আছে। পূর্বজদের কাছে শুনেছি, জমিদারি আমলে এখানেই মহাধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত। পুজো অবশ্য এখনও হয়। জঙ্গলাকীর্ণ ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসতেই ছোট তরফের বর্তমান বংশধর কাশীনাথ রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। আলাপ জমে উঠতেই চণ্ডীমণ্ডপ দেখিয়ে কাশীনাথ বললেন, এখন এখানেই পুজো হয়। আগে বেড়ার ঘর ছিল। ছেলে চাকরি পাওযার পর মায়ের পাকা মন্দির বানিয়েছি।
ব্রিটিশ যুগে চূড়ামণ বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। জমিদার নিজের হাতে গ্রামের সমাজ ব্যবস্থা সাজিয়েছিলেন। এই এক গ্রাম যেখানে হাঁড়ি, পাটনি, জেলে, ছুতোর, চর্মকার মায় ব্রাহ্মণ সকল সম্প্রদায়ের বাস। পুজো নিয়ে গ্রামেরই বাসিন্দা পূর্ণচন্দ্র দাসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। অশীতিপর পূর্ণচন্দ্র জানালেন, মাঝে জমিদার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় গ্রামবাসীরাই চাঁদা তুলে পুজোটিকে ধরে রেখেছিলেন। এখন পরিস্থিতি সচ্ছল হওয়ায় ফের জমিদারবাড়ির সদস্যরাই একক উদ্যোগে পুজো করছেন। তবে এখনও গ্রামের সব স্তরের মানুষ এই পুজোতে শামিল হন। সত্যি কথা বলতে, এই মন্দিরের প্রতিমাদর্শন না করলে পুজোর আনন্দ উপভোগই হয় না। দশমীর দিন শতাব্দীপ্রাচীন মেলাতেও এলাকার হিন্দু, মুসলিম সহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ আসেন। চূড়ামণ হরিতলার মাঠে হাল আমলের ছেলেছোকরার দল একটি বারোয়ারি পুজো শুরু করেছেন বটে। তবে এই তল্লাটে জমিদারবাড়ির পুজোই এখনও গ্রামবাসীদের নিষ্ঠা ও ভক্তি নিবেদনের একমাত্র পীঠস্থান। দেবী দুর্গা এখানে সকলের কাছেই যেন ঘরের মেয়ে উমা।
বড় তরফের জমিদার ভূপালচন্দ্র রায় চৌধুরী দুর্গাপুরে চলে যাওয়ার পর গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপুজো শুরু করেন। ভূপালচন্দ্র ছিলেন প্রজাবৎসল। তাঁর মৃত্যুর পর ওই এলাকার নাম হয় ভূপালপুর। ভূপালপুরের আপামর মানুষেরও পুজো নিয়ে সমস্ত আনন্দ-আবেগ এই রাজবাড়ির পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। জমিদার পরিবারের বংশধর সন্তু রায় চৌধুরীর কথায়, বাবা ও ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনেছি, আগে এখানে দুর্গা মন্দিরের পাশে পুজোর সময় যাত্রাপালা ও কবিগানের আসর বসত। এখন আর সেসব নেই। তবে আশপাশের মানুষের এই পুজোকে ঘিরে নিষ্ঠা ও ভক্তি একটুও কমেনি। আজও পুজোর চারদিন দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে। একটু ঘুরে আসা যাক রাযগঞ্জ ব্লকের বাহিন জমিদারবাড়ি। এখানে নাগর নদীর পাড়ে পরিত্যক্ত ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ির সামনে দাঁড়ালে যে কারও মনে পড়বে মান্না দের গাওয়া সেই গানের কলি ‘দেখি মুকুটটা তো পড়ে আছে, রাজাই শুধু নেই।’ সেই কোন কালে জমিদারি উচ্ছেদের পর ভিটেমাটি ছেড়ে বংশধরেরা চলে গিয়েছেন অজানা মুলুকে। পড়ে রয়েছে নির্জন অট্টালিকা আর ঠাকুরদালান। জমিদার পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ না রাখলেও বাহিন গ্রামের মানুষ ভুলে যাননি দেবী চণ্ডীকে। কার্যত গ্রামবাসীরাই এখন পুরোনো সেই ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। পুজো কমিটির সভাপতি ভোলা গোস্বামী বললেন, জমিদার রুদ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর হাতে শুরু হওয়া এই পুজো এখন আমরা গ্রামবাসীরাই চাঁদা তুলে ধরে রেখেছি। নদীর ওপারেই বিহার। আগের মতো এখনও বিহারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বহু মানুষ আসেন এই প্রতিমাদর্শনে।
শুধু উত্তর দিনাজপুরের চূড়ামণ, ভূপালপুর, বাহিনেই নয়, জমিদারদের স্মৃতিবিজড়িত এমন পুজো ছড়িয়ে আছে গৌড়বঙ্গের অন্য দুই জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদাতেও। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রাজবাড়িগুলো জেগে ওঠে শরতের এই পুজোর কালে। যেমন মালদার হবিবপুর ব্লকের সীমান্ত গ্রাম সিঙ্গাবাদের রায়বাড়ির পুজো। সেই কোন কালে উত্তরপ্রদেশ থেকে নদীপথে বাংলাদেশে ডালের ব্যবসা করতে এসে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমিদারি পেয়েছিলেন অবোধনারায়ণ রায়। তাঁর শুরু করা সেই দুর্গাপুজো পুরোনো রীতি মেনে আজও শূন্যে পাঁচ রাউন্ড বন্দুকের গুলি ছুড়ে সূচনা হয় সিঙ্গাবাদে। এই জেলারই হরিশ্চন্দ্রপুরে রয়েছে আরেক রায় জমিদারবাড়ির পুজো। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সৌমিত্র রায় ও তাঁর শরিকরা এই পুজো করেন এখন। চাঁচল রাজবাড়ি থেকে কিছুটা দূরে সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর স্মৃতিধন্য পাহাড়পুর জমিদারবাড়ির চণ্ডীমণ্ডপেও পুজোর আযোজন হয়ে আসছে প্রতি বছর। চাঁচল রাজবাড়ির পুজো তো বটেই, পাহাড়পুরের পুজোকে ঘিরেও এলাকার মানুষের নস্টালজিয়া কম নেই। পাশের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর ব্লকের দানগ্রাম চৌধুরীবাড়ির পুজো এবার ১২৫ বছরে পা রাখল। ওদিকে তপনের মনোহলিতে রয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায়বাড়ির পুজো। পতিরামে ঘোষবাড়ির পুজো ও বালুরঘাটে সাহারায় বাড়ির পুজোতেও মিশে রয়েছে জমিদারি আমলের ঐতিহ্য।