নৃসিংহপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, কুমারগ্রাম : টম হ্যাংকসের ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’ দেখেছেন? বিমান দুর্ঘটনায় পরিবহণ সংস্থার এক কর্মী জনমানবহীন এক দ্বীপে পেঁছে কীভাবে বছরের পর বছর জংলিদের মতো সেখানে কাটিয়ে শেষটায় বাড়ি ফিরলেন, তা নিয়েই অসাধারণ সেই সিনেমা। কথায় বলে, বাস্তবের ভিতেই সিনেমা দাঁড়িয়ে। কুমারগ্রামে রায়ডাকের নদীচরে ঘটে যাওয়া দুঃসাহসিক ঘটনাই হয়তো ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’র মতো সিনেমাকে পথ দেখায়। এক প্রৌঢ়া হেঁটে ওই নদী পার হতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ করে নদীতে জল বেড়ে যাওয়ায় নদীর মাঝে চরে আটকে পড়েন। এক বা দু’ঘণ্টা ধরে নয়, টানা প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে খোলা আকাশের নীচে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জনমানবশূন্য নদীচরে একাকী ছিলেন। নাইলনের ব্যাগে থাকা চাল জলে ভিজিয়ে কোনওমতে পেটের জ্বালা মিটিয়েছেন। নদীতে ভেসে আসা কাঠ, গাছের গুঁড়ি সংগ্রহে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বৃহস্পতিবার রাতে প্রৌঢ়ার চিৎকার শুনতে পান। খবর পেয়ে ব্লক প্রশাসন রাত থেকেই তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। সোমবার সকালে তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
কুমারগ্রামের বিডিও মিহির কর্মকার বললেন, ‘ওই মহিলা দুর্গম ধুমপাড়াঘাট থেকে উত্তরে বন দপ্তরের নজরমিনার থেকে কিছুটা দূরে মাঝ নদীচরে আটকে পড়েছিলেন। খবর পেয়ে ঘটনাটি ওপরমহলকে জানাই। রাতেই উদ্ধারকারী দল আসে। প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা বৃহস্পতিবার রাতে হুপনি হাঁসদা নামে ওই প্রৌঢ়াকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাই। কিন্তু দুর্যোগের কারণে সম্ভব হয়নি। সকালে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমাদের ধারণা, ওই মহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন। তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে খোঁজখবর চলছে।’
বৃহস্পতিবার ঝড়জলের রাতে বহু চেষ্টা করেও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা নদীচরে আটকে পড়া ওই প্রৌঢ়ার সঠিক অবস্থান খুঁজে বের করতে পারেননি। এদিন ভোরের আলো ফুটতেই তাঁর খোঁজে অমরপুর ৮ নম্বর বস্তি থেকে ফের তল্লাশি অভিযান শুরু হয়। বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের সদস্যদের পাশাপাশি কুমারগ্রাম থানার পুলিশকর্মীরাও সেখানে ছিলেন। আশপাশের কয়েকটি চর ঘুরে ওই প্রৌঢ়ার কোনও হদিস না মেলায় স্পিডবোট নিয়ে রায়ডাক নদীর উজানে তল্লাশি চালানো হয়। শেষপর্যন্ত ভারত-ভুটান সীমান্তে ধুমপাড়াঘাট থেকে বেশ কিছুটা উত্তরে বক্সার জঙ্গল ঘেরা জনমানবহীন রায়ডাক নদীর চরে ওই প্রৌঢ়ার খোঁজ মেলে। সকাল ৭টা নাগাদ তাঁকে নির্জন নদীচর থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য কুমারগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। দুপুরের দিকে একটা সময় ওই মহিলা সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর বিকেলের দিকে তাঁকে কামাখ্যাগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে রেফার করা হয়।
অনেক চেষ্টার পর তদন্তকারীরা জানতে পারেন হুপনির স্বামীর নাম নগেন সোরেন। স্বামী আজকাল অন্য এক মহিলাকে নিয়ে ঘর করেন। সেই যন্ত্রণায় হুপনি বাংলাদেশের রংপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানা এলাকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু কীভাবে কোন পথে এই মহিলা ভারত-ভুটান সীমান্তের নির্জন ধুমপাড়াঘাটের উত্তরে একেবারে পাহাড়-জঙ্গলঘেরা রায়ডাক নদীর চরে এলেন তা নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকরা ধন্দে পড়েছেন। হুপনি কোথায় যাচ্ছিলেন তাও পরিষ্কার নয়। কুমারগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওই প্রৌঢ়ার সঙ্গে কথা বলে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে নদী পেরোতে গিয়ে তিনি যে মাঝপথে আটকে গিয়েছিলেন তা কোনওমতে সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন। সপ্তাহখানেক ধরে অসহায় অবস্থায় খোলা আকাশের নীচে কোনওমতে ছিলেন। সঙ্গে থাকা চাল জলে ভিজিয়ে নরম করে কোনওমতে পেট ভরিয়েছেন। বজ্রবিদু্যত্ সহ দুর্যোগের রাতে অন্ধকারে জনমানবশূন্য নদীচরে থেকেছেন। শুনে রীতিমতো গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বাস্তবে এমন সমস্ত ঘটনা ঘটে বলেই ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’র মতো সিনেমা পর্দায় ধরা দেয়।