প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। কোনওদিন কমিটির বৈঠকে গড়হাজির থাকেন না। অথচ বিগত সংসদীয় বাদল অধিবেশনের শেষলগ্নে লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা সাংসদ অধীর চৌধুরী। বৃহস্পতিবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তাঁর অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো৷ কিন্তু তাতে ফারাক বুঝতে দেননি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সদস্যরা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে আনা তিনটি নতুন অথচ বিতর্কিত বিল সম্পর্কে আলোচনায় এদিন অধীরকে ছাড়াই আক্রমণ শানালেন ডেরেক ও’ব্রায়েন, দয়ানিধি মারান-র মতো বর্ষীয়ান বিরোধী দলীয় সাংসদরা।
প্রসঙ্গত, দেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইনে রদবদল ঘটানোর উদ্দেশে তিনটি নতুন বিল- ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ভারতীয় স্বাক্ষ্য বিল নিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিগত বাদল অধিবেশনে সংসদে পেশ করা হয়েছে এই তিনটি বিলকে৷ তারপরেই বিজেপি সাংসদ ব্রিজলানের অধীনস্থ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাতে বিলগুলিকে তুলে দেওয়া হয়েছে জরুরি সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য৷ এই আবহে এদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিলগুলির যৌক্তিকতা এবং বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল তৃণমূল কংগ্রেস৷ সংসদীয় সূত্রের দাবি, দিল্লিতে আয়োজিত স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিল তিনটি প্রণয়ণের কারণ জানতে চান কমিটির সদস্য, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব অজয় ভাল্লাকে হাতের নাগালে পেয়ে ডেরেক প্রশ্ন তোলেন, কেন পুরোনো আইনে সংশোধনী না এনে সরকার তিনটি নতুন বিল প্রণয়ণ করতে চাইছে?
সূত্রের খবর, ডেরেককে সমর্থন জানিয়েছেন কমিটির সদস্য ইন্ডিয়া জোটের প্রতিনিধি বর্ষীয়ান সাংসদ দিগ্বিজয় সিং, দয়ানিধি মারান, রভনীত সিং বিট্টুরা৷ আগামী ১১ এবং ১২ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে কমিটির পরবর্তী বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব ডেরেকের প্রশ্নের উত্তর দেবেন বলে জানানো হয়েছে৷ সংসদীয় সূত্রে খবর, এই মর্মেই ডেরেক দাবি তুলেছেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দিল্লিতে বসে বৈঠক না করে দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকার, বার কাউন্সিল, সমাজকর্মী, আরটিআই কর্মী সহ সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের মতামত সংগ্রহ করার পরই বিলগুলি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক৷ দেশের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং সাধারণ নাগরিক সমাজের সঙ্গে সবিস্তারে আলোচনা না করেই বিলগুলিকে একতরফাভাবে তৈরি করা হয়েছে সংসদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা মাথায় রেখে, এহেন অভিযোগ তুলেছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট৷
এই আবহে এদিন বিজেপি সাংসদ ব্রিজলালের নেতৃত্বাধীন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সামনে তিনটি বিলের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব অজয় ভাল্লা৷ তাঁর বক্তব্য রাখার আগেই বৈঠকে বক্তব্য পেশ করার দাবি জানান সদস্য ডিএমকে সাংসদ দয়ানিধি মারান৷ কমিটির রুল অনুযায়ী তিনি নিজের বক্তব্য রাখার সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের সভাকক্ষে উপস্থিতির বিরোধিতা করেন৷ সূত্রের খবর, এই সময়েই কমিটির চেয়ারম্যান ব্রিজলালের নির্দেশে সভাকক্ষ ছেড়ে সাময়িকভাবে উঠে যেতে হয় স্বরাষ্ট্র সচিব অজয় ভাল্লাকে৷ জানা গিয়েছে, এরপরই বিল তিনটি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানান দয়ানিধি। বিলগুলির নামকরণ, প্রণয়নের সময় এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের অনুমতি না নেওয়ার বিষয় উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেন দয়ানিধি মারান৷ বিলগুলিকে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন হিসেবে ব্যাখ্যা করেন তিনি৷ তাঁর দাবি, অহিন্দিভাষীদের কাছে এই বিলের নাম উচ্চারণ করা যেমন কঠিন হচ্ছে তেমনি বিলের বিষয়বস্তুও অত্যন্ত জটিল৷ এই মর্মে চারপাতার একটি চিঠি উনি তুলে দিয়েছেন কমিটির চেয়ারম্যান ব্রিজলালের হাতে, দাবি সংসদীয় সূত্রে৷
‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রতিনিধি কমিটির কয়েকজন সদস্য মনে করছেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যখন আলোচনা করছে, তখন লোকসভায় সাসপেন্ড হওয়া কংগ্রেস সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরীর ‘অনুপস্থিতি’ বড় ফ্যাক্টর হয়ে যাচ্ছে৷ এ কথা পরোক্ষে স্বীকারও করেছেন বিরোধী শিবিরের প্রতিনিধিরা। বিরোধী শিবিরের এক বর্ষীয়ান নেতা বলেন, ‘অধীর চৌধুরী শুধু পোড়খাওয়া রাজনীতিক নন, তিনি কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা, পাব্লিক অ্যাকাউন্টস কমিটির অধ্যক্ষ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিষয়ক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও৷ বিতর্কিত যে তিনটি বিল নিয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে অধীরের উপস্থিত থাকা দরকার ছিল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জেরে তাঁকে সংসদ থেকে দূরে রাখা হল। এটা দুর্ভাগ্যজনক।’ এই প্রসঙ্গেই কলকাতা থেকে অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘আমি বহিষ্কৃত বলে কমিটির বৈঠকে থাকতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু কমিটির অন্য বিরোধী সদস্যরা যথেষ্ট কৃতি এবং যোগ্য প্রতিনিধি। তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে অগণতান্ত্রিক বা অসংসদীয় যে কোনও বিষয়কে প্রতিহত করতে সক্ষম। আমার শুভেচ্ছা রইল।’