নবনীতা মণ্ডল, শ্রীনগর: ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে৷ তাপমাত্রা কুড়ি ডিগ্রির আশপাশে৷ বেশ ঠান্ডা লাগছে জোলো হাওয়ায়৷ দূরে ঘণ্টাঘর আবছা মনে হচ্ছে বৃষ্টির ঝাপটায়৷ গাড়ির সারথি আতিবের ডাকে ঘোর কাটল, ‘ম্যাডাম, লাল চক পৌঁছ গয়ে হম৷’
গাড়ির বাইরে পা রাখার আগেই মনে পড়ল, এই সেই বিখ্যাত লাল চক। যেখানে দাঁড়িয়ে ১৯৪৮ সালে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু৷ আর তার পরেই কাশ্মীরের তত্কালীন মুখিয়া শেখ আবদুল্লার গলায় শোনা গিয়েছিল সেই বিখ্যাত সংলাপ- ‘মন তু সুদাম, তু মন সুদি, তাকস না গোয়েদ, মন দেগ্রাম তু দেগ্রি’। অর্থাৎ, ‘আমি তোমাতে রূপান্তরিত হচ্ছি, তুমি আমাতে। এর পরে আর কেউ বলতে পারবে না আমরা আলাদা৷’ এই একটা পংক্তির মাধ্যমে ভারতের অভিন্ন অংশ হয়ে গিয়েছিল জম্মু ও কাশ্মীর৷
এর পরে এল ২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট৷ জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকা থেকে প্রত্যাহার করা হল সংবিধানের ৩৭০ ধারা৷ নেহরু তাঁর ভাষণে ১৯৪৮ সালে বলেছিলেন, ‘কাশ্মীরের অধিবাসীরা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে পারবেন, বেছে নিতে পারবেন নিজেদের জনপ্রতিনিধি।’
৭৬ বছর পরে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা হারানো জম্মু ও কাশ্মীরের একদা রাজধানী শ্রীনগরের লাল চকে দাঁড়িয়ে সবার আগে মাথায় এল, এবারের লোকসভা ভোটে সত্যিই কি কাশ্মীর পারবে তাদের নিজেদের জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে? বিশেষত ৩৭০ ধারা নামক রক্তক্ষয়ী বুলেট এবং অবিরাম রক্তক্ষরণের জ্বালা বুকে নিয়ে?
প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে শুরু হল পথ চলা। লাল চকে ঘণ্টাঘরের ঠিক বাঁদিকে সৈয়দ আবদুল্লার তিন পুরুষের শালের দোকান। বাংলা থেকে এসেছি শুনে মুখে হাসি নিয়ে এগিয়ে এলেন। ‘কেমন আছে লাল চক ৩৭০ ধারা ওঠার পর?’ একবাক্যে বললেন, ভালো। কিন্তু চোখটা নামিয়ে নিলেন। বুঝলাম, আরও কিছু বলতে চাইছেন। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, ‘হয়তো পুরোনো লাল চক নেই, অশান্তি কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমরা ভালো নেই। পাঁচ মিনিট অন্তর সিআরপিএফের টহলদারি। এলাকায় পর্যটকের সংখ্যা বাড়লেও ব্যবসা প্রায় লাটে উঠেছে।’
আপাতত শান্ত লাল চক। তবে শ্রীনগরে আক্ষেপ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কিছুটা এগিয়ে দেখা হল বেকারি দোকানের মালিক সইফ মালিকের সঙ্গে। কথা বলতে গেলে রীতিমতো ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য, ‘কী হবে বলে? নেতিবাচক কিছু বললেই তো রাতে বাড়িতে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যাবে।’ অর্থাৎ শাসকের রক্তচক্ষুর শাসনে ৩৭০ বিলোপের পর শান্ত আছে ভূস্বর্গ, শান্ত আছে কাশ্মীর, শান্ত আছে লাল চক। কিন্তু অনেকটাই যেন শ্মশানের শান্তি।
লাল চক হয়ে ডাল লেক, সেখান থেকে অনন্তনাগ গেলাম। যেখানেই যাই না, প্রশ্ন করতেই লোকে ‘ভালো আছি, ভালো আছি’ বলছেন। তার আড়ালে যেন বলতে চাইছেন, প্রবল নিরাপত্তার চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। অজানা সাংবাদিকের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলার তেমন ভরসা নেই কাশ্মীরের মানুষের।
এই পরিস্থিতিতে তা হলে ভোটটা কেমন হবে এখানে? বিজেপি লোকসভার ভোটে কোনও প্রার্থী দিচ্ছে না এখানে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ক’দিন আগে কাশ্মীরে ঘুরে গেলেও লোকসভার কথা সত্যি বিজেপি নেতাদের মাথায় নেই। আসল লক্ষ্য, সেপ্টেম্বরের বিধানসভা ভোট। তাঁরা চাইছেন, ইন্ডিয়া জোটের তিন পার্টি জাতীয় কনফারেন্স, পিডিপি এবং কংগ্রেস আপাতত নিজেদের মধ্যে লোকসভা ভোটে মারপিট করুক। পরে বিধানসভায় তার ফসল তোলা যাবে। এবং তিন পার্টি ওইভাবেই মুখোমুখি লড়াইয়ে ব্যস্ত। অমিত শা এখানে বলে গিয়েছেন, তিন পার্টির কাউকেই ভোট না দিতে।
২০২৪-এর নির্বাচনে কোনওরকম অশান্তি চায় না কেন্দ্রীয় সরকার। তাই গোটা কাশ্মীরজুড়ে একদিকে যেমন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে, ঠিক তেমনই রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ এবং বিএসএফও। শ্রীনগর থেকে পুলওয়ামা, ট্রাল, অনন্তনাগ পুরো এলাকাই রয়েছে সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনীর দখলে। এতদিন পর হতে চলা লোকসভা নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎসাহর পাশাপাশি রয়েছে আশঙ্কা। ভোটের ময়দানে নেমে ইতিমধ্যেই ওমর আবদুল্লার ঘোষণা, কাশ্মীরে সরকার গড়বে ন্যাশনাল কংগ্রেস। যদিও নিশ্চিত হতে পারছে না সাধারণ মানুষ।
পুলওয়ামার তিন পুরুষের কেশর ব্যবসায়ী জামরুদ পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘প্রচার তো হচ্ছে নির্বাচনের। কিন্তু আমাদের অবস্থার কি কোনও পরিবর্তন হবে?’ ভীতসন্ত্রস্ত গলা তাঁর, ‘এখন তো বর্তমান অবস্থার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা যাবে না। তাহলে রাতে পুলিশ এসে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।’ একই সুর শোনা গেল অনন্তনাগের সাধারণ বাসিন্দাদের গলাতেও। ৪০ বছর ধরে অনন্তনাগ বাসস্ট্যান্ডে শাল বিক্রি করছেন ৭৪ বছরের জুলফিকার। কাঁপা কাঁপা গলায় তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘৩৭০ উঠে যাওয়ার পর প্রথম নির্বাচন এখানে। প্রশাসনের চাপে আপাতত শান্তি বজায় রয়েছে কিন্তু কতদিন এই শান্তি থাকবে সন্দেহ।’ শ্রীনগরের ট্যাক্সিচালক আবদুল্লাহ যেমন বলেই দিলেন, ‘প্রশাসনের চাপে এলাকা এখন ছাই চাপা অবস্থায় রয়েছে।’ আবার মনে হল, শ্রীনগরজুড়ে শান্তি বজায় থাকলেও সেটা সব কথা নয়। এলাকার বাসিন্দারা মন খুলে কথা বললে উঠে আসবে সেই শ্মশানের শান্তির কথা।