- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
আগামী মাসের গোড়াতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিন-তিনটি সভা করতে আসছেন এই রাজ্যে। প্রধানমন্ত্রী একবার কেন, একটি রাজ্যে দশবার আসতেই পারেন। তিনটি কেন, তিরিশটি জনসভা করতেই পারেন। কিন্তু এবার প্রধানমন্ত্রীর তিনটি জনসভা করার অন্যরকম গুরুত্ব। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক মুখে মোদি এমন একটা সময়ে আসছেন, যখন সন্দেশখালি নিয়ে উত্তপ্ত রাজ্য রাজনীতি। এই উত্তাপের আঁচ সারা দেশেই ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি।
এ কথাও অনস্বীকার্য, সন্দেশখালির ঘটনাবলি নিয়ে রাজ্য সরকার এবং শাসকদলের মুখ অনেকটাই পুড়েছে। এমন আবহে মোদি তাঁর তিনটি জনসভা থেকে এই আগুনে আরও কিছু ঘি ঢেলে যাবেন এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে যে বিজেপি ভোটের সময়ে পরিকল্পিতভাবে সুর চড়াতে চাইছে, তা তাদের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীদের বক্তব্য এবং কর্মসূচিতে স্পষ্ট। স্মৃতি ইরানি, রবিশংকর প্রসাদ, অনুরাগ ঠাকুর, জেপি নাড্ডার মতো কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীরা সন্দেশখালি প্রসঙ্গে কড়া ভাষায় গাল পেড়েছেন তৃণমূলকে। প্রথমদিকে এই ঘটনায় একটি সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতিটি উসকে দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি তাঁরা। স্মৃতি, শুভেন্দুরা ‘হিন্দু মহিলা ধর্ষিতা’ এরকম তকমা মেরে দিয়ে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের কার্ডটি বাজারে ফেলেছিলেন। কিন্তু শাহজাহানের যে সঙ্গীদের বিরুদ্ধে এই ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ্যে আসায় বিজেপি নেতা-নেত্রীরা প্রকাশ্যে এই খেলাটি আপাতত বন্ধ করেছেন।
রাজ্যের বিজেপি নেতাদের এখন প্রাত্যহিক গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে সন্দেশখালি। দুর্জনে অবশ্য বলছে, সন্দেশখালি অভিযানের পিছনে তৃণমূলকে আক্রমণ করাও যেমন লক্ষ্য, তেমনই পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার একটা প্রতিযোগিতাও রয়েছে বিজেপি নেতাদের ভিতর। সন্দেশখালি নিয়ে আন্দোলনকে আরও চড়া মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মোদির ইচ্ছাপূরণে ৩৭০ আসন দখল করতে গেলে বিজেপিকে বাংলা থেকেও তাদের আগে জেতা আসনগুলিকে ধরে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে আসন সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
সন্দেশখালির ঘটনাকে বিজেপি যে ভোটে শক্তিশালী হাতিয়ার করতে চায় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে বিজেপির জাতীয় পরিষদের বৈঠকে মোদি সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তৃণমূলের কড়া সমালোচনা করেছেন। গত এক বছরে হিংসা বিধ্বস্ত মণিপুর থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী তড়িঘড়ি বাংলায় তিনটি জনসভা করতে ছুটে আসছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সন্দেশখালির দড়ি টানাটানিতে শেষপর্যন্ত কে জিতবে? বামফ্রন্ট জমানার শেষদিকে নন্দীগ্রামের ঘটনা সকলের স্মরণে আছে। নন্দীগ্রামের আন্দোলনকে মমতা সাফল্যের সঙ্গে কলকাতার রাজপথে এনে ফেলতে পেরেছিলেন এবং তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। সন্দেশখালিতে তাদের আন্দোলনকে বিজেপি নেতৃত্ব কলকাতার রাজপথে এনে তাকে জন আন্দোলনের রূপ দিতে পারবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
তার প্রথম কারণ, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের দীর্ঘ আন্দোলনের কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। দ্বিতীয়ত, জয় শ্রীরাম স্লোগান এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে আবদ্ধ হয়ে থাকলে বিজেপির পক্ষে এই রাজ্যে দলমতনির্বিশেষে সকলকে শামিল করে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মমতা সাফল্য পেয়েছিলেন কারণ সিপিএমের মতো সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছিল। তাছাড়া মমতার রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশও ছিল না। ফলে বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষজনের নন্দীগ্রাম আন্দোলনে শামিল হতে অসুবিধা হয়নি এবং সেই আন্দোলনটিকে মমতা নিছক তাঁর দলীয় আন্দোলন হিসেবে না রেখে গণ আন্দোলনের রূপ দিতে পেরেছিলেন।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে ভাগ বসানোর মতো কোনও বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছিল না তখন। এখন তৃণমূল বিরোধী আন্দোলনে ভাগ বসাতে কংগ্রেস-সিপিএম-আইএসএফ রয়েছে। কাজেই পুরো ক্ষীরটা বিজেপির ভাগ্যে নাও জুটতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এবার কী করবেন মমতা? মোদি এই রাজ্যে এসে তিনটি জনসভা করে বিজেপির আন্দোলনকে আরও চড়া সুরে বাঁধার পর মমতা কীভাবে তার মোকাবিলা করবেন? এটা অস্বীকার করা যায় না, শুধু সন্দেশখালি নয়, বিভিন্ন জেলায় শাহজাহান এবং তাঁর চ্যালাচামুণ্ডাদের মতো গত দশ বছরে গজিয়ে ওঠা জমি মাফিয়ারা রাজনৈতিক প্রশ্রয়েই এই সব অন্যায় করার সাহস পেয়েছে। এই জমি মাফিয়াদের মাথায় শাসকদলের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীর হাত রয়েছে। যারা বছরের পর বছর এদের প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের কেউ কেউ আবার এখন বিজেপিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। শেখ শাহজাহানের সঙ্গে বিজেপিতে আশ্রয় নেওয়া নেতার ছবিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সমাজমাধ্যমে।
মমতা প্রথম থেকে কড়া হাতে এই রাশটি ধরতে পারতেন। ধরেননি, সেটা মমতার ভুল। এখন এদের আড়াল করতে যাওয়াটা আরও ভুল। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতো এরা এখন গিলে খেতে চাইছে গোটা ব্যবস্থাটাকে। এর থেকে সরকার এবং দল কীভাবে বেরিয়ে আসবে তার উপায় মমতাকে বের করতে হবে।
মমতা বলেছেন, আমি এখন সুতো ছাড়ছি। কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সন্দেশখালি নিয়ে পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, মমতা তখন হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রয়েছেন, এমন ভাবাটা ভুল। পালটা রাজনৈতিক চাল চালতে মমতা অনেকের থেকে দক্ষ। এটি সবথেকে ভালো বোঝেন মোদি। বিধানসভা নির্বাচনে ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মতো প্রতি সপ্তাহে রাজ্যে এসেছিলেন মোদি। সব জেলাতে সভা করেছিলেন। তবুও বিজেপিকে একশো পার করাতে পারেননি। মনে হচ্ছে, এবারও লোকসভা ভোটের আগে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করবেন তিনি। কিন্তু শুধু জনসভা করে যে মমতাকে কাবু করা যাবে না তা মোদি জানেন।
ইতিমধ্যেই আধার কার্ড বাতিলের ইস্যুতে হইচই ফেলে মমতা বিজেপিকে হাত তুলে সাফাই গাইতে বাধ্য করেছেন। সন্দেশখালিতেও বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে অকথা-কুকথার জেরে অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপি। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষজন বিক্ষোভ দেখিয়েছে বিজেপির রাজ্য সদর দপ্তরে। ভিনরাজ্যেও শিখ নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ফলে অল্প আয়াসে বিজেপি লড়াইটা জিতে যাবে এমনটা বোধহয় নয়। শেষপর্যন্ত মমতা কীভাবে সুতোটা গোটান তা দেখতে অপেক্ষা করতেই হবে। তখন বোঝা যাবে সন্দেশখালি নন্দীগ্রাম হতে পারল কী পারল না।