- রণজিৎ ঘোষ
‘রাজনীতি’- শব্দটা আজ বড় লজ্জিত। যে ন্যায়, নীতি, আদর্শ নিয়ে একটা সময় মানুষ রাজনীতির মঞ্চে আসতেন, আজ তার বড্ড অভাব। কোথায় নীতি, কোথায় আদর্শ, কোথায় গেল জনহিতের চিন্তাভাবনা? রাজনীতির মঞ্চে পুরোটাই এখন দুর্নীতি আর ব্যক্তিস্বার্থে ভরা।
আরও খোলসা করে বললে, রাজনীতি এখন একটা ব্যবসা। বিনা শিক্ষাদীক্ষা, বিনা পুঁজিতে প্রচুর রোজগারের একটা পথ। এটা জানেন না এমন লোক অন্তত ভূভারতে মেলা ভার। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক লাভলি মৈত্রের মতো কেউ কেউ মুখ ফসকে মাঝেমধ্যে এই সত্যি কথাটা বলে ফেলেন। ‘দল ইকুয়াল্স টু রোজগার’- এটা শুধু একটা কথার কথায় নয়, রাজ্য রাজনীতির হালচিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লাভলির দাবি, কে কীভাবে কোথা থেকে রোজগার করেন সেই খবর তাঁর কাছে রয়েছে। দলে না থাকলে সেই রোজগার হবে না এটাও তিনি স্পষ্টতই বলে ফেলেছেন। আর এতেই রাজনীতির প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গিয়েছে। লাভলির বক্তব্যের সঙ্গে নিজেদের মতের মিল খুঁজে পাচ্ছেন রাজ্যের তাবড় তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
রাজনীতিতে এসে নিজের নামের আগে একটা অলংকার জুড়তে অর্থাৎ অঞ্চল থেকে ব্লক, জেলা কমিটির পদ পেতে এখন লক্ষ লক্ষ টাকা দাদা-দিদিদের উপঢৌকন দিতে হয়। শুধু কি তাই, নির্বাচনে প্রার্থীতালিকায় নাম তুলতেও প্রচুর টাকার খেলা হয়। নিজের জেলা হোক বা প্রদেশ, সেটিং করতে না পারলে পঞ্চায়েত, পুরসভা ভোটেও দলের টিকিট জুটবে না।
যে নেতা বা নেত্রী লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে দলের পদ হোক বা জনপ্রতিনিধি হতে টিকিট কিনছেন, তিনি ক্ষমতা পেলে সেই টাকা সুদে-আসলে তুলতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর তাই দিকে দিকে এখন তোলাবাজি, দুর্নীতি, সরকারি জমি বিক্রির মতো সিন্ডিকেটের ছড়াছড়ি। আর্থিক সুবিধা আদায়, ধান্দাবাজি ছাড়া রাজনীতির ময়দানে আছেটা কী?
শিলিগুড়ির কথাই ধরুন না। এখানে দল এবং সরকারি পদকে ব্যবহার করে ছাত্র, যুব থেকে শুরু করে দলীয় সংগঠনের বেশিরভাগ নেতার সকাল থেকে রাত একটাই লক্ষ্য, টাকা, আরও টাকা। তা সে বেআইনি নির্মাণে মদত দিয়ে, প্রোমোটার, বড় ব্যবসায়ীকে হুমকি দিয়ে অথবা রিকভারি এজেন্ট হিসাবে কমিশনের মাধ্যমেও আয় করছেন। সরকারি অফিসের কোটি কোটি টাকার টেন্ডার পেতেও এখন এজেন্সিকে নেতাদের সিন্ডিকেটে মাথা ঠুকতে হয়।
সেই এজেন্সি যতই অভিজ্ঞ হোক, যোগ্যতা যতই বেশি থাকুক, নেতাদের সিন্ডিকেটে দাবিমতো কমিশন না দিলে কাজ পাবেন না। ইদানীং আবার নেতাদের সিন্ডিকেটই তলে তলে কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে। নিরুপায় প্রশাসনেরও চোখ বন্ধ। সিন্ডিকেটে থাকা শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের বিশ্বাস, পুলিশ তাদের, প্রশাসন তাদের। হুমকি দিলেও কোনও আইনি পদক্ষেপই হবে না। মিডিয়া জেনে গেলে একদিন লিখবে, তারপর সবাই চুপ।
উত্তরবঙ্গকে করিডর করে প্রতি রাতে শয়ে-শয়ে গোরু, মহিষ, শুয়োর পাচার হচ্ছে। ইদানীং কয়লা পাচারের করিডর করা হচ্ছে এই উত্তরবঙ্গকে। এই পাচারের মাধ্যমে রাজ্যের বড় মাথারা যেমন আয় করেন, তেমনই মদত দিয়ে জেলার নেতারাও কম যান না। এক নেতার কথায়, মাসে উত্তরবঙ্গের সব জেলায় নেতা-নেত্রী, প্রশাসনকে সামলাতে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে এই সিন্ডিকেট।
ভাবুন একবার, মাসে কোটি টাকা ঘুষ দিতে হলে কত কোটি টাকার চোরাচালান হয়?
এখানেই শেষ নয়, শাসকদলে বিভিন্ন পদ রাখতেও কলকাতায় মোটা টাকা পাঠাতে হয়। যে নেতারা টাকার বিনিময়ে পদ নিচ্ছেন, তাঁদের পদ রাখার জন্যও মাসে মাসে মোটা টাকা মাসোহারা দিতে হচ্ছে। নেতাদের অনেকেই বলছেন, ‘শুধু কি আমরাই টাকা খাই? নিয়মিত উপরমহলে পাঠাতে হয়। বাজার থেকে না তুললে কোথায় পাব? ১২ টাকা তুললে তবেই না নিজের জন্য দু’টাকা রেখে ১০ টাকা পাঠাতে পারব।’
প্রশ্ন হল, এভাবে কতদিন টাকা রোজগার চলবে।