- সন্দীপন নন্দী
আবার একটি দিন সমাগত। বিদ্যার্থী জীবনে সকলের অগ্নিপরীক্ষার সেই মাধ্যমিক ফল। এ যেন মেধা অন্বেষণের এক বার্ষিক গতি সমাপ্তির প্রত্যুষকাল।
পাড়ায় পাড়ায়, অলিগলির সেইসব বাড়িতে প্রথম নিউজ ব্রেকিং-এর ঘোড়দৌড় চলে। কৃতীদের প্রিয় খাবার, প্রিয় গান, প্রিয় লেখক, প্রিয় বিষয়ের মতো গতানুগতিক প্রশ্নগুলো ধেয়ে আসে ঠিক। আর তাতেও থেকে যায় কিছু মিষ্টিমুখের সেলফি, সহপাঠীদের সঙ্গে উল্লাসে সংবাদের প্রথম পাতা। তারপর সংবর্ধনা আর রঙিন কাগজে মোড়া উপহারের স্তূপগুলো নির্বাক পড়ে থাকে সকলের ঘরে ঘরে।
এখন প্রশ্ন? এই ‘হল অফ ফেমে’ প্রবেশাধিকার পেল যারা, পরবর্তীতে তারা কেমন থাকল? সে খবরের হদিস আমরা ক’জন রাখি? আচ্ছা, ১৯৯২-এর মাধ্যমিকে রাজ্যে প্রথম ছাত্রের নাম ক’জন বলতে পারেন? এক নীরবতা বিরাজমান ক্লাসরুমের ছাত্রদের মতো ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকলেন সকলে। আসলে এসব প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়রা ততক্ষণই মূল্যবান যতক্ষণ আমরা তাদের প্রাসঙ্গিক করে রাখি।
অথচ যে ছাত্ররা টেস্টে কোনওক্রমে পাশ করার পর সকালের রোদের মতো ভালো নম্বরে ঝকঝক করে উঠেছিল প্রগতিপত্রে কিংবা অঙ্কে টেনেটুনে পাশ করেও বাংলায় লেটার পেয়ে গভীর বেদনায় ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল নীরবে। এইসব ছাত্রছাত্রীদের নাম কোথাও প্রকাশিত হল না। কোনও সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল এই অনন্যদের স্টোরি করল না।
একসময় অনেক টিচার্স কমনরুমের দেওয়ালে সেই স্কুলের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে প্রথমদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা দেখেছি। অথচ আজ এ ঘটনার প্রসঙ্গ টানাই বৃথা। কেননা পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের হাত ধরে মেধাতালিকা পুরোপুরি তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ফল? কয়েক মাস বাদেই এক ম্যাজিকের মতো রদবদল ঘটে যায় এ তালিকায়।
স্টুডিওতে যে ছাত্রীটি মাধ্যমিকে দ্বিতীয় হয়ে গিটার বাজিয়ে রবিগান গেয়ে গেল, তার ভবিতব্যের সন্ধান করলেন না কেউ। এটাই মেধাতালিকার গ্রাউন্ড রিয়েলিটি। অথচ এই দু’দশক আগেও স্টার পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের দেখতে ছুটে আসতেন পড়শিরা। একটা সমীহের বাতাবরণ তৈরি হয়ে যেত ফলাফলের বিকেলে। আজ রাম নেই, নেই অযোধ্যাও। স্টার মার্কসটাই শূন্যে বিলীন হল ক্রমে। পঁচাত্তর শতাংশ নম্বরপ্রাপ্ত কুলীন ছাত্ররাই আজ অপাঙক্তেয়, মূল্যহীন ফুটো আধুলিসম। কারণ সর্বত্র ৯৮.৪, ৯৯.২ সংখ্যার নম্বরসমুদ্র থইথই করছে।
এই তো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আসলে এই প্রত্যাশার পর্বত নির্মাণের জন্য আমরাই দায়ী। তাই মাধ্যমিকে মুর্শিদাবাদের এক ছাত্রীর সাফল্যের পর তার বাবা গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, দশ বছর কোথাও ঘুরতে না যাওয়ার ফল আজ পেলাম। এই তো মোদের রোবট প্রজন্ম। যেখানে আবেগের স্থান নেই। যে পৃথিবীর কোনও মেধাবাড়ির নিমন্ত্রণে একে একে পাতে পড়বে নম্বরের ঝোল, নম্বরের চাটনি, নম্বরের তরকারি। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা জোর করে তা গিলবে। যা আর কোনও ছোটগল্পের জাদুবাস্তবতা হয়ে রইল না। এক চিরন্তন রিয়েলিটি। বুঝলেন?
( লেখক বালুরঘাটের বাসিন্দা। প্রবন্ধকার)