- সায়ন্তন দাস অধিকারী
ব্রিটেনের যাবতীয় নির্বাচনি সমীক্ষার একটাই পূর্বাভাস, ব্রিটেনের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের মেয়াদ নাকি ফুরিয়ে এসেছে। সমীক্ষা সংস্থা ইউগভ এটাও বলছে যে ঋষি তাঁর নিজের উত্তর ইয়র্কশায়ারের আসনটিও খোয়াতে পারেন। ব্রিটেনের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৫-এর ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। নির্বাচন যখনই হোক না কেন, ঋষির কনজারভেটিভ পার্টির যে ভরাডুবি হতে পারে তার আভাস পাওয়া গিয়েছে বেস্ট ফর ব্রিটেন নামক একটি প্রচারাভিযান সংস্থার দ্বারা প্রকাশিত এক সমীক্ষাতেও।
নির্বাচনি সমীক্ষাগুলোর মতে আগামী নির্বাচনে মাত্র দেড়শোর কাছাকাছি আসন পাবে ঋষি সুনকের দল। অন্যদিকে চারশোর বেশি আসনে জিততে চলেছে বিরোধী লেবার পার্টি। আনুমানিক ভোট ভাগের ভিত্তিতে পৃথক পার্লামেন্টারি আসনের ফলাফলের ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এই সমীক্ষা সংস্থা ইউগভ। তাদের সবশেষ সমীক্ষা বলছে, আসন্ন নির্বাচনে সুনকের কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ১৫৫টি আসনে জয়লাভ করবে। আর বিরোধী লেবার পার্টি জিতবে ৪০৩ আসনে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে মোট আসন সংখ্যা ৬৫০। ২০১০ থেকে ব্রিটেনের ক্ষমতায় রয়েছে কনজারভেটিভরা। কখনও জোট, কখনও এককভাবে সরকার গড়েছে তারা। এই চোদ্দো বছরে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী বদলেছে ব্রিটেনে। এই কনজারভেটিভ শাসনকালেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে ভোটাভুটি এবং কোভিড সংকট মোকাবিলা নিয়ে কেলেঙ্কারিতে দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে পড়েছিল দলটি।
ইউগভের সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে কনজারভেটিভরা ১৯৯৭ সালের চেয়েও কম আসন পাবে। ওই বছর দলটি টোনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির কাছে বিশাল পরাজয়ের শিকার হয়েছিল। তারা জিতেছিল মাত্র ১৬৫ আসনে। ইউগভ জানিয়েছে, কনজারভেটিভ পার্টির উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে যাঁরা নির্বাচনে হারতে পারেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী পেনি মর্ডান্ট। সমীক্ষার জন্য গত ৭ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ১৮ হাজার ৭৬১ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ নাগরিকের সাক্ষাৎকার নেয় ইউগভ। সংস্থাটি জানিয়েছে, আসন্ন নির্বাচনে লেবার পার্টি ৪১ শতাংশ এবং কনজারভেটিভরা ২৪ শতাংশ ভোট পেতে পারে। সমীক্ষায় আরও দেখা যাচ্ছে, বিরোধী নেতা স্যর কেয়ার স্টারমারের দল লেবার পার্টি ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ঋষি সুনকের দল কনজারভেটিভ পার্টির থেকে ১৯ পয়েন্টে এগিয়ে আছে। সমীক্ষায় দাবি করা হয়, ব্রিটেনের বর্তমান মন্ত্রীসভার আনুমানিক ২৮ জন সদস্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তবে তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৩ জন পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন।র
এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় ফলাফলের খবর আসছে বৃহস্পতিবারের লন্ডনের মেয়র নির্বাচনের। ১০ জন মেট্রো মেয়র, প্রায় ৩০০০ কাউন্সিলার, ৩৭ জন পুলিশ অ্যান্ড ক্রাইম কমিশনার, আর সেই সঙ্গে ২৫ জন লন্ডন অ্যাসেম্বলির সদস্যকে নির্বাচিত করার জন্য গত বৃহস্পতিবার ভোট দিলেন ব্রিটেনবাসী। যেখানে লেবার পার্টির বর্তমান লন্ডন মেয়র সাদিক খানের তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল বলেই জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সাভান্তা। সাদিকের বিপরীতে কনজারভেটিভ পার্টির সুসান হল সমীক্ষার হিসেবে অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। এই প্রতিবেদন লেখার সময় দেখলাম, বৃহস্পতিবারের উপনির্বাচনে ব্ল্যাকপুল সাউথে সংসদীয় আসনটি কনজারভেটিভদের হাত থেকে লেবার পার্টি ছিনিয়ে নেওয়া ছাড়াও ইংল্যান্ডের কাউন্সিলার নির্বাচনে লেবার পার্টি ইতিমধ্যেই তিনশোটির উপর আসন পেয়ে গিয়েছে, যেখানে কনজারভেটিভ পার্টি দ্বিতীয় স্থানেও নেই। লিবেরাল ডেমোক্র্যাটিক বা লিবডেম দল দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসছে। ব্রিটেনের মানুষ এই আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধিকেই কনজারভেটিভ দলের ব্যর্থতা হিসেবে তুলে ধরছেন। টিভি খুললেই দেখা যাচ্ছে কত মানুষ এই ঠান্ডাতেও বাড়ির হিটার চালিয়ে রাখতে পারছেন না। বিদ্যুতের বিল একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার উপরে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের বর্ধিত ইন্টারেস্ট রেটের জন্য বাড়ির মর্টগেজের মাসিক খরচও প্রায় দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
ঋষি সুনককে যদি প্রধানমন্ত্রীর আসন খোয়াতেই হয় আর লেবার পার্টি যদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে তাহলে ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন লেবার পার্টির বর্তমান লিডার স্যর কেয়ার স্টারমার। পেশায় ব্যারিস্টার স্যর স্টারমার ২০২০-তে জেরেমি করবিনকে সরিয়ে লেবার পার্টির প্রধান নির্বাচিত হন। ব্রিটেনের স্থানীয় বাঙালি মহলের ধারণা স্যর স্টারমার এলেও ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অবস্থার খুব একটা আকস্মিক পরিবর্তন হবে না। মূল্যবৃদ্ধির চোটে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার জোগাড় ব্রিটেনবাসীর। প্রথমে ব্রেক্সিট, তারপরে কোভিড আর শেষ অবধি ইউক্রেন যুদ্ধ ব্রিটেনের অর্থনীতিকে প্রায় কফিনবন্দি করে ফেলেছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ঋষি সুনক। কিন্তু ব্রিটেনের গত চল্লিশ বছরের সর্বাধিক মূল্যবৃদ্ধিকে আয়ত্তে আনা যায়নি এখনও।
ঋষি সুনক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত দু’বছরে সব মিলিয়ে যত বক্তব্য আজ অবধি দিয়েছেন তার একটি বড় অংশই দিয়েছেন গত দু’সপ্তাহে। ঋষি ডিসেবিলিটি বেনিফিট কিংবা সিক নোট নিয়ে কথা বলছেন, ইমিগ্রেশন ও রোয়ান্ডা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন যে তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। কিন্তু আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য সেটা কতটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে লন্ডনের বাঙালি মহলের সন্দেহ আছে। লন্ডনবাসী শিক্ষাবিদ ডঃ রেজওয়ানা আনওয়ার বলছিলেন, ‘২০২১-এর রাজনৈতিক মুডের সঙ্গে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক মুডের তুলনা করলে চলবে না। ২০২১-এ বরিস জনসন ক্ষমতায় থাকাকালে এমনকি লাল দেওয়ালও নীল হওয়ার কারণ ছিল ভ্যাকসিন রোল আউট। এটা সত্যি যে ভ্যাকসিন ও করোনায় আমজনতাকে অর্থনৈতিক সাহায্য ভোটের ব্যাপারে বিপুলভাবে কনজারভেটিভের পক্ষে গিয়েছে। ভ্যাকসিনের সেই সফলতায় জনগণের মন থেকে সরকারের করোনা মোকাবিলার প্রথম দিকের ব্যর্থতাকেও ভুলিয়ে দিয়েছিল। অথচ এখন স্থানীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে কনজারভেটিভ পার্টি জনমত সমীক্ষায় ২০ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে যা কিনা লিজ ট্রাসের দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে স্বল্পকালীন অবস্থানের চাইতেও নীচে নেমে গিয়েছে।’
২০২২-এর ২৫ অক্টোবর ঋষি সুনক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঋষি গত দু’বছর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী।
স্থানীয় বাঙালি মহলের মতে, কনজারভেটিভের ভরাডুবিতে ঋষির রাজনৈতিক কেরিয়ারের সমাপ্তি ঘটবে নিঃসন্দেহে। তিনি হয়তো ফিরে যাবেন ক্যালিফোর্নিয়াতে বিলাসবহুল জীবনে অথবা তাঁর নিজস্ব ফিন্যান্স সেক্টরে। এখন তিনি ব্রিটেনকে তামাকমুক্ত দেশে পরিণত করতে আইন পাশ করার চেষ্টা করছেন। তামাক বিরোধী বিলটা হল পয়লা জানুয়ারি ২০০৯-এর পরে জন্মগ্রহণকারীদের সিগারেট বিক্রি করা হবে অবৈধ। আগামী জুন মাসে হাউস অফ লর্ডসের সিলমোহরের অপেক্ষায় আছে ঋষির এই বিলটি। যদি এটা পাশ হয়ে যায় তাহলে এ দেশের ইতিহাসে হয়তো এটাই লেখা থাকবে যে ঋষি সুনকই ছিলেন সেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী যিনি ব্রিটেনে তামাক বিরোধী আইন করেছিলেন। ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয় হিসেবে হয়তো সেটাই আমরা মনে রাখব।
(লেখক কর্পোরেট কর্তা, লন্ডনের বাসিন্দা।)