- শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
অন্ধকারে থাকলে যা হয় আর কি! একটুখানি আলো দেখেই ভয় পেয়ে গেছে আমেরিকা। আর ভয় পেলেই কোনও প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ যা করে, ‘আলো নেভাতে’ পুলিশ লেলিয়ে দেয়! আমেরিকা অবধারিতভাবে সেটাই করছে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখেছিলেন, ‘যেখানে অন্ধকার, সেখানেই ঈশ্বর। যেইমাত্র সেখানে আলো পড়িল, অমনি ঈশ্বর দূরীভূত হইল’!
মুক্ত প্যালেস্তাইনের দাবিতে, ইজরায়েলের ‘অবৈধ’ দখলদারির বিরুদ্ধে আমেরিকায় এখন লু-এর মতো বইছে ছাত্র আন্দোলন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে লাখো অযুত ছাত্রছাত্রী শুরু করে দিয়েছে অবস্থান বিক্ষোভ ধর্না মিছিল সভা ও জমায়েত। এই বিদ্রোহী প্রতিবাদে শামিল অভিবাসী ছাত্রছাত্রীরাও। ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ ডেভিড ব্রুক্স লিখেছেন, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল আমেরিকার ‘প্যাথলজিকাল’ দাদাগিরির বিরুদ্ধে এই ছাত্র অভ্যুত্থান ভিয়েতনাম পর্বের যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির নিজস্ব নিরাপত্তাবাহিনীকে ‘জিরো টলারেন্স’-এর নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এমনকি ছাত্রদের শায়েস্তা করতে তারা শিক্ষাঙ্গনে পুলিশ নামিয়ে দিয়েছে। ক্যাম্পাস এখন কালো পোশাক, ভারী বুট, বন্দুক আর হাতকড়ার দখলে। সরস্বতীর পদ্মবনে মত্ত হস্তীর লীলা!
দুই চোখ বুজে এইসব খবর শুনলে মনে হবে, ঘটনাগুলি ঘটছে মার্কিন পরিভাষায় বর্ণিত তৃতীয় বিশ্বে! রূপকথার গল্পে আছে, আবিশ্বের মানবাধিকার রক্ষায় আমেরিকার দরদ উথলে ওঠে। সেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চত্বরে পুলিশ ঢুকেছে! কারণ, ছাত্ররা নাকি পড়াশোনা না করে রাজনীতি করছে! ভর্তি হওয়ার সময় ছাত্ররা নাকি মুচলেকা দিয়েছে, কর্তৃপক্ষ যা-ই করুক, শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলাভঙ্গ করতে পারবে না। এই নিয়মাবলির মোদ্দা কথা হল, প্রশাসনের কথার ওপর কথা বললেই ক্লাস ও হস্টেল হইতে বিদায়। ছাত্ররা সেটা শোনেনি। বিদ্যার্থীরা শুধু বলছেন, প্যালেস্তাইনের মুক্তিযুদ্ধকে জঙ্গি কার্যকলাপ বলা যাবে না। যদিও ছাত্ররা অরাজক হয়নি, হিংস্র হয়নি। তবু তাঁদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বিরুদ্ধে ক্রমশ নিঠুরতর হয়ে উঠছে পুলিশ। কারণ, আমেরিকার মাননীয় সরকার যেখানে বলছে যে, ইজরায়েল সঠিক, সেখানে ছাত্রছাত্রীরা প্যালেস্তাইনকে সমর্থন করছে কোন সাহসে! কাজেই ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ শিক্ষা দিতে ছাত্রদের মারো, ধরো, এবং জেলে পোরো। পল আভেরি বলেছেন, ‘পাওয়ার উইদাউট অ্যাবিউজ লুজেস ইটস চার্ম’!
সেই ক্ষমতার সৌন্দর্যরক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালন করতেই চলতি ছাত্র আন্দোলনের দাউদাউ আগুনের মধ্যেও চুপটি করে বসে আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাঁর মতে, এ সব নাকি ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ধর্মীয় উন্মাদনা। অথচ প্যালেস্তাইন আর ইজরায়েলের সংঘাত আসলে সাম্রাজ্যবাদী মালিকানা বনাম স্বাধীনতার লড়াই। এই বছরের প্রথম চার মাসে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে খুন হয়ে গেছেন বারোজন অভিবাসী ভারতীয় ছাত্র। বাইডেন বলেছেন, ও সব নাকি নিছকই ডাকাতি বা ছিনতাই! ছাত্রছাত্রীদের কাছে কত ডলার থাকে যে, তা হস্তগত করার জন্য তাঁদের প্রাণে মারতে হবে! আদতে কে না জানে যে, ও সব আমেরিকার ক্রমবর্ধমান বর্ণবিদ্বেষের পরিণাম! সব শিয়ালের এক রা! ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, অভিবাসী ছাত্রছাত্রীরা প্যালেস্তাইনের হয়ে কথা বললেই দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশে ক’জন মুসলিম আছে তা খুঁজে বের করতে ‘সিএএ’ চালু করে দেন। ‘দি ওয়াশিংটন টাইমস’-এ জেফ মারডক লিখেছেন, ‘‘বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কাছেই অভিবাসী বা তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীরা হল ‘সফট টার্গেট’! প্রমাণ, চলতি আন্দোলনের শুরুতেই সর্বপ্রথম দুজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দুজনই অভিবাসী ভারতীয়।’’ ওঁদের ‘আমেরিকান কেরিয়ার’ শেষ। কারণ, আমেরিকায় স্থায়ী বসবাস (গ্রিন কার্ড) এবং নাগরিকত্বের আবেদনে রীতিমতো হলফনামা দিয়ে জানাতে হয় যে, ‘কোনওদিন কোনও দেশদ্রোহী আন্দোলনে জড়িত থাকিব না’। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই জঙ্গি বা জেহাদি। একদা যেমন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের বলা হত অ্যানারকিস্ট!
ভরসার কথা এই যে, প্যালেস্তাইনবাদী আন্দোলনকারীদের মধ্যে অজস্র মার্কিন ছাত্রছাত্রী এবং এমনকি শিক্ষক-শিক্ষিকারাও আছেন। তাঁদের অনেককেই নির্বিচারে ধরপাকড় করা হয়েছে। বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে। নৃশংস কোনও অপরাধীর মতোই ক্লাসরুম বা টিচার্স রুমের সামনে থেকে তাঁদের টেনেহিঁচড়ে হাতকড়া পরিয়ে, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বা চুলের মুঠি ধরে, মারতে মারতে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়েছে। ছাত্রী আর শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে ওরকম জঘন্য আচরণ করছে পুরুষ পুলিশরা। আর মহিলা পুলিশরা পোস্টার বা ফেস্টুন ছিঁড়ছে, আন্দোলনকারীদের তাঁবু বা মঞ্চ ভেঙে দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনও সর্বেসর্বা বুক বাজিয়ে বলছেন, নষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ছবি দেখে ওই দুষ্ট গোরুদের চিহ্নিত করতে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির ম্যারাথন বৈঠক চলছে। তৈরি হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের কালো তালিকা, যা ন্যাশনাল স্টুডেন্টস রেকর্ডের ডেটাবেসে তুলে দেওয়া হবে। হয়তো এই তালিকার শিরোনাম হবে, ‘সাবধান, কামড়ায়’! তাই না দেখে মার্কিন দেশের মুনাফাখোর শিক্ষা ব্যবসায়ীরা সমস্বরে নিদান দেবেন, রাষ্ট্রদ্রোহীদের শিক্ষার অধিকার নেই। বড়দের চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা শিক্ষাশ্রমের আচরণবিধির পরিপন্থী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এটাই তো ‘জ্ঞানমূলক নিপীড়ন’!
প্রসঙ্গত, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাস তপোবনের মতোই সুন্দর। বিশেষ করে তথাকথিত ‘ভালো’ ইনস্টিটিউশনগুলির। এবং একটা আশ্চর্য তথ্য হল, হার্ভার্ড থেকে এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড থেকে প্রিন্সটন, এমরি থেকে জর্জিয়া টেক, কলম্বিয়া থেকে ইয়েল, সর্বত্রই ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে মেধা বা মার্কশিটের পাশাপাশি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হল, ছাত্রদের বাবা-মায়েদের ট্যাঁকের জোর। এরা চরম মেধাবী ছাত্রছাত্রীদেরও বৃত্তি প্রায় দেয় না বললেই চলে। পড়াশোনার প্রবল চাপের মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের দোকানে বাজারে কাজ করে নিজের থাকাখাওয়ার খরচ তুলতে হয়। কর্তৃপক্ষ শিক্ষান্তে চাকরির ক্যাম্পাসিংয়ের যে ব্যবস্থা করে, সেটা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। অথচ ‘পাশ করলেই চাকরি’র লোভ দেখিয়ে ওরা অভিভাবকদের কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার হাতিয়ে নেয়। সেই অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় সাজানো হয়, যাতে সবার চোখ ঝলসে যায়। শিক্ষার বাজারিকরণ। প্রোমোশনাল বিউটিফিকেশন। চ্যাপলিন বলতেন, ‘সৌন্দর্য হল নর্দমায় ভেসে যাওয়া পুষ্পস্তবক’!
সেই সুন্দর বাজারের চেহারা কী এখন? ক্লাসফ্লাস ডকে উঠেছে। উৎসব অনুষ্ঠান, মায় সমাবর্তন বন্ধ। ক্যাফেটারিয়া শুনসান। ক্যাম্পাসের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছাত্রছাত্রীদের ছেঁড়া জামা জুতো। যত্রতত্র পড়ে আছে আন্দোলনের জন্য তৈরি অস্থায়ী ছাউনির ভগ্নস্তূপ। সিকিউরিটি পেট্রলিংয়ের চাকায় পিষে যাচ্ছে ফেস্টুন, ‘সাইলেন্স ইজ ভায়োলেন্স’! অগুনতি পুলিশ মাড়িয়ে যাচ্ছে পোস্টার, ‘লেট আস স্পিক’! চারপাশে অন্ধকার, গভীর, গভীরতর। যে অন্ধকার ভালোবাসে শুধুই অপরাধীরা। এই গাঢ়তর আঁধারের মধ্যেই ‘গো হেল ইজরায়েল’ স্লোগান দিতে দিতে মশাল জ্বালাচ্ছেন সকাল আটটা ন’টার সূর্যের মতো ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের একহাতে লিফলেট, ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন’। অন্যহাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। এই তো চাই! ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো / সেই তো তোমার আলো! সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভাল’!
(লেখক প্রাবন্ধিক, আমেরিকার ন্যাশভিলের বাসিন্দা)