- শৌভিক রায়
‘অসৃকপাভয় সত্রস্তৈ কৃতা ত্বং হোলি বালিশৈঃ/ অতদ্বাং পূজয়িষ্যামি ভূতে ভূতিপ্রদা ভবঃ’
অশুভকে হারিয়ে শুভর জয়। অন্যায়কে পরাস্ত করে ন্যায়ের অনুশাসন। আবহমানকাল থেকে হোলি এই কথাই বলে এসেছে।
বাঙালি জীবনে অবশ্য হোলি পরে। আগে দোলযাত্রা। বিশেষ করে যদি সেটি কোচবিহারের ক্ষেত্রে হয়, তবে তো কথাই নেই! আসলে এই অঞ্চলে দোলযাত্রা সহ হোলির উৎসব প্রাণের দেবতা মদনমোহন জিউকে ঘিরে। তাই তাঁর সঙ্গে দোলযাত্রায় না মাতলে, রং না খেললে মন ভরে না।
একসময় কোচবিহারে দোলযাত্রা শুরু হত বসন্তপঞ্চমী তিথিতে। রাসমেলা বা লাইনের মাঠে ‘শাখাপত্রযুক্ত’ বাঁশ প্রোথিত হত ওদিনই। সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট পলাশ ‘বৃক্ষমূলে’ আমন্ত্রণ করে পলাশ ফুল তোলা বিষয়টিও ছিল উৎসবের অঙ্গ। ‘কোচবিহার দর্পণ’-এ জীবনকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘পূর্বকালে এই দিন হইতেই অত্র নগরীতে বসন্তোৎসব আরম্ভ হইত।’ রাতে চাঁদের আলোতে চলত ফাগুয়া কীর্তন।
নিয়ম বদলায়নি। অতীতের মতো এখনও শুক্লা-চতুর্দশীতে বহ্ন্যুৎসব বা মেষদাহন হয়। কারুকার্যখচিত রত্নসিংহাসনে, ফুলমালা পরে, মদনমোহন উপস্থিত থাকেন। শোভাযাত্রা শেষে মন্দিরের পশ্চিমে, আলাদা মণ্ডপে, অন্য বিগ্রহদের সঙ্গে, চতুর্দোলায় দোলও খান।
পরদিন সন্ধ্যায় বাণেশ্বর ও ষণ্ডেশ্বর থেকে আনা বিগ্রহ নিয়ে আবার চলে শোভাযাত্রা। বাজনা বাজিয়ে নির্দিষ্ট পথ পরিক্রমা শেষে তাঁদের আনা হয় মাঠে। সেদিন মদনমোহন উপস্থিত না থাকলেও, তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে হাজির থাকেন ব্রহ্মাণীর চৌকি থেকে আনা শ্যামসুন্দর। এরপর প্রত্যেক বিগ্রহকে দ্বারবক্সীর ‘সমন্ত্রক ফল্গুসিঞ্চন’ প্রদান দোলযাত্রার সমাপ্তি ঘটায়।
নিয়ম আছে। পরম্পরা আছে। কিন্তু দোলযাত্রা ঘিরে উন্মাদনা আর নেই। নেই সেই ভিড়ও। ভাটা পড়েছে উৎসাহে। ‘হ্যাপি হোলি’তে অভ্যস্ত বর্তমান প্রজন্ম এইসব থেকে অনেক দূরে। তাদের কাছে দোল নেহাতই একটি ছুটির দিন যার পর আসে হোলি।
আগে কোচবিহারের গ্রামাঞ্চলেও দোলযাত্রার ব্যাপক প্রচলন ছিল। দেখা যেত দোলমেলা বা ‘শোয়ারী’। বাড়িতে ছোট ছোট মণ্ডপ করে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ রেখে দোলযাত্রা উদযাপনের রীতিও ছিল। সে সবও হারিয়ে গিয়েছে কবেই।
এখন বরং হোলির আনন্দ বেশি। মাথায় টুপি আর চোখে রঙিন চশমা পরে হিন্দি চটুল গানে ঠুমকা লাগানোই রেওয়াজ। আর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বিচিত্র সেজে হুল্লোড়বাজি। এর মধ্যে দোলযাত্রার সেই শান্ত মাধুর্য আর কোথায়! কোথায় বড়দের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করবার সেই রীতি? আজকাল সবকিছুই বড্ড উচ্চকিত। দোলের সঙ্গে মিল নেই কিছুতেই। শান্তিনিকেতনের ধাঁচে চালু হওয়া বসন্তোৎসবও দোলের জায়গা নিতে ব্যর্থ।
এসব দেখেই মনে হয়, আমাদের মননে দোল ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। আসলে হোলি যতটা আবেদন রাখতে পেরেছে, দোলযাত্রা সেভাবে পারেনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার চল এখন। হোলি ঘিরে অর্থনীতির আবর্তনও নজরকাড়া। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে হোলিতে মেতে ওঠে সবাই।
তবে নানা বদল এলেও সর্বসাধারণের উৎসব হিসেবে দোলযাত্রা সহ হোলির বিকল্প নেই। অন্য কোনও উৎসবেই দেবতা এভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে নেমে আসেন না। মেতে ওঠেন না রঙিন হওয়ার খেলায়।
বসন্ত দিনের মধুক্ষরা পৃথিবীতে তাই রঙের উৎসব প্রকৃতই মধুময়। সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে সে সত্যিই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
(লেখক শিক্ষক। কোচবিহারের বাসিন্দা)