- জয়ন্ত চক্রবর্তী
সারা জীবন ধরে আমাদের একের পর এক ঘর বদল হতে থাকে। ঘরের দরজা। দরজার পেছনে হালকা সবুজ জেড আকৃতির বাটাম। ধুসর সাদা দেওয়াল। ছোট্ট ঘুলঘুলি ডিঙিয়ে দেওয়ালে পড়া সকালের সেই একচিলতে হলুদ রোদ্দুর।
দেওয়ালের গায়ে ছোট চৌকো মতো তাক। তাকে সাজিয়ে রাখা মায়ের দেওয়া ছোট্ট সরস্বতী। ইলেক্ট্রিক সুইচ বোর্ড। আরও কত কী! যত দিন যায়, আমরা এগুলো হারাতে থাকি। কেননা জীবনে আমাদের বাড়ি বদল হয়। তাই তো ঘর বদল হতে থাকে। পুরোনো ঘর একদিন অতীত হয়ে যায়। কোনও এক বিনিদ্র রাতে হঠাৎ এক মায়াবী ছায়া হয়ে সেই ফেলে আসা ঘর চুপি চুপি ফিরে আসে। ফিশফিশ করে কিছু কথা বলে। তারপর দিনের আলো ফুটতেই আবার ফিরে যায়।
সেই ঘর থেকে বেরিয়ে সরু বারান্দা। বারান্দা আর উঠোন পেরিয়ে মুলিবাঁশের তৈরি হালকা গেট। গেট খুলতেই মোরাম বিছানো পাড়াগাঁয়ের পথ। পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই উত্তম সেলুন। পাশে শম্ভুদার চায়ের দোকান। দোকানের এককোণে কয়লার আঁচে, লোহার চাটুতে অল্প তেলে ভাজা পরোটা। আহা কী ঘ্রাণ! সব একদিন কীভাবে কীভাবে যেন অতীত হয়ে যায়।
প্রতিটি মানুষের জীবনের সঙ্গে কমবেশি একাধিক ঘর বদল জড়িয়ে আছে। একটু বড় হতেই বাড়ির ভেতরে ঘর বদল দিয়ে শুরু। তারপর একদিন হয়তো বা নিজের বাড়ি ছেড়ে মেসবাড়ি কিংবা হস্টেল। আরও পরে কর্মসূত্রে প্রথম ভাড়াবাড়ি। সেখানে পরিবার আর আসবাব নিয়ে দু’কামরার বাড়িতে গাদাগাদি করে থাকা এবং জীবনে উত্তরণের স্বপ্ন দেখা। স্বপ্ন সফলতা পেলে, একদিন ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিজের স্বপ্নের বাড়িতে গিয়ে ওঠা। এখানেই কি শেষ? এরপরও ঘর বদল হতে থাকে। কখনও ভিটেমাটি ছেড়ে সন্তানসন্ততির বাড়িতে গিয়ে ওঠা। অথবা বৃদ্ধাশ্রম!
অথচ নিজের অজান্তেই একদিন সেই ঘরের সঙ্গে, সেই দরজার সঙ্গে, জানলা দরজার ছিটকিনির সঙ্গে, শম্ভুদার চায়ের দোকানের সঙ্গে অথবা পাড়ার ভেতরে সারাবছর খুব তাচ্ছিল্যে পড়ে থাকা নিঃসঙ্গ এক শীতলা মণ্ডপের সঙ্গে আমাদের এক অজ্ঞাত সখ্য গড়ে ওঠে। সবকিছু বড় আপন মনে হয়। কখনও মনেই হয় না, এই জায়গাগুলো ছেড়ে একদিন অন্যত্র চলে যাব। তারপর সময় বের করে আর ফিরে আসা হবে না কোনওদিন! দেখা হবে না মেসবাড়ির সেই খয়েরি পাড় সাদা শাড়ি পড়া রান্নার মাসির সঙ্গে। কোনওদিন খোঁজ নিয়ে জানা হবে না গলির রাস্তার মোড়ে ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই স্কুল বালিকার আমার মতো পঞ্চাশ পেরিয়ে চুলে পাক ধরেছে কি না!
প্রতিটি ঘর বদলের আগে আমরা আরও উত্তরণের স্বপ্ন দেখি। নতুন ঘরে যাওয়ার সময় পুরোনো ঘরের দিকে অপু-সর্বজয়া-হরিহরের মতো আলো আবছায়া চোখে তাকিয়ে থাকি। এভাবেই আমরা মায়া-মায়া ছায়ার ভেতর দিয়ে বহু হারিয়ে যাওয়াকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাই। এটাই জীবনের বাস্তবতা। জীবনব্যাপী বারবার এমন অজস্র হারিয়ে ফেলার মধ্যে নিজের অজান্তেই আমরা কখন যেন শিখে যাই, আরও বড় কিছু হারিয়ে ফেলার শিক্ষা।
(লেখক দিনহাটার স্কুল শিক্ষক)