Sunday, April 28, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়পদ্মের ‘মাইন্ডগেম’ স্পষ্ট প্রার্থীতালিকায়

পদ্মের ‘মাইন্ডগেম’ স্পষ্ট প্রার্থীতালিকায়

  • গৌতম হোড়

লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়নি, তার আগেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল ১৯৫টি আসনে প্রার্থীর নাম জানিয়ে দিচ্ছে, এমন ঘটনা কবে ঘটেছে, আদৌ ঘটেছে কি না মনে করতে পারলাম না। বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে সব প্রার্থীর নাম ঠিক থাকত, কিন্তু তা জানানো হত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর। অতীতে দেখতাম, বিজেপি ও কংগ্রেস একে অন্যের তালিকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রার্থীদের নাম জানাতে দেরি করেছে।

কিন্তু এবার এই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত কেন? কারণ, যে কোনও নির্বাচনেই একটা ‘মাইন্ড গেম’ কাজ করে। মানুষের মনে একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টাও থাকে। সেই ধারণাই অনেক সময় জয়পরাজয় নির্ধারণ করে দেয়। নরেন্দ্র মোদি আগেই দলের লোকসভা আসন জেতার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, বিজেপি এবার ৩৭০ আসন জিতবে। এনডিএ জিতবে অন্তত চারশো আসন। তারপর এমন একটা আবহ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে মানুষের মনে হয়, এরাই তো জিতছে। আশপাশে, সামনে-পিছনে কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। এরা তো এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে তারা ১৯৫ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দেয়।

যাঁরা এতদিন ধরে মোদি এবং অমিত শা’র কার্যপদ্ধতি কিছুটা হলেও খেয়াল করেছেন, তাঁরা জানেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের একটাই মানদণ্ড। জেতার সম্ভাবনা কতটা আছে। যদি জেতার সম্ভাবনা না থাকে অথবা কেউ যদি মোদি-শা’র কাছে বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে ছেঁটে ফেলতেও তাঁরা দ্বিধাবোধ করেন না। কে জিততে পারবেন, তা ঠিক করতে একের পর এক সমীক্ষা করা হয়। সাধারণ মানুষের রায় নেওয়া হয় সেই সমীক্ষার মাধ্যমে। সেইসঙ্গে দলের কর্মীদের রায় নেওয়া হয়। আরএসএসের স্বয়ংসেবক, যাঁরা ওই এলাকায় কাজ করেন, তাঁদের রায় নেওয়া হয়। দেখা হয় জাতপাতের অঙ্ক, দেখা হয় দলের চিরাচরিত ভোট কত, দেখা হয়, কোন বিষয় সেখানে প্রাসঙ্গিক। দেখা হয় সাংসদ যদি বিজেপির থাকে, তাহলে তিনি কতটা জনপ্রিয় বা তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কতটা প্রবল।

যদি দেখা যায়, বিজেপির কোনও নেতার জয় নিয়ে সংশয় আছে, অন্য দলের নেতা বিজেপিতে এলে তিনি নিজের জোরে কয়েক শতাংশ ভোট জোগাড় করতে পারেন, তাহলে তাঁকে বিজেপিতে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হয়ে যায়।

দিল্লির প্রার্থীদের দিকেই তাকানো যাক। দিল্লির পাঁচটি আসনে বর্তমান সাংসদকে ছাঁটাই করা হয়েছে। যাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা কেউ হেঁজিপেজি প্রার্থী নন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মীনাক্ষী লেখি, যিনি মন্ত্রীও ছিলেন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সাহেব সিং বর্মার ছেলে প্রবেশ বর্মা, গুর্জরদের বাহুবলী নেতা রমেশ বিধুরী, প্রাক্তন ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর এবং আরএসএসের কাছের নেতা প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনকে প্রার্থী করা হয়নি।

নয়াদিল্লি কেন্দ্রে মীনাক্ষীর জেতার সম্ভাবনা যে কম তা এলাকার মানুষের ক্ষোভ থেকেই স্পষ্ট ছিল। মানুষের পাশে না থাকার একটা মূল্য দিতে হয় রাজনীতিকদের। মীনাক্ষীকেও দিতে হল। বিশেষ করে এবার দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেসের মধ্যে জোট হয়েছে। নয়াদিল্লি কেন্দ্র আপ লড়বে। কংগ্রেসেরও এই কেন্দ্রে কিছু ভোট আছে। ফলে তাদের সামনে মীনাক্ষী দুর্বল প্রার্থী হতেন। তাই নিয়ে আসা হল প্রয়াত সুষমা স্বরাজের মেয়ে বাঁশুরিকে। বাঁশুরিও আইনজীবী, মহিলা প্রার্থী এবং একেবারে নতুন মুখ। তাঁর সঙ্গে আছে সুষমা স্বরাজের উত্তরাধিকার।

ওই যে বললাম, মোদি-শা’র একমাত্র বিচার্য বিষয় হল জয়ের সম্ভাবনা। সেটা থাকলে পরিবারবাদে কোনও আপত্তি নেই। বিজেপির কাছে পরিবারবাদ তো শুধু বিরোধী দলেই থাকে। নেতা-নেত্রীদের ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, ভাইদের ঢালাও টিকিট দেওয়ার পরেও বিজেপি বলে, শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবারের কেউ নেই, তাই এটা পরিবারবাদ নয়। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বিজেপিতে যোগ দেন, প্রার্থী হন, তখনও পরিবারবাদ হয় না।

গম্ভীর যতটা তেড়েফুঁড়ে রাজনীতির ইনিংস শুরু করেছিলেন, পরে আর সেই জোশ তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। আবার তিনি ক্রিকেটের দুনিয়ায় ঝুঁকে পড়েছেন। দলের রাজনীতির পিচ যে বাউন্স-ভরা হয়, সেখানে ব্যাট করতে আলাদা দক্ষতা লাগে সেটা গম্ভীর নিশ্চয়ই এতদিন বুঝতে পেরেছেন। সেইসঙ্গে এটাও বুঝেছেন, নির্বাচন কেন্দ্রর মানুষকে খুশি করার কাজটাও সহজ নয়। তাঁর জায়গায় প্রার্থী করা হয়েছে জনপ্রিয় গাইয়েকে। আবার সেই জেতার সম্ভাবনার গল্প।

বিজেপির প্রথম তালিকায় মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা ২৮। শতাংশের হিসাবে মাত্র ১৪ শতাংশ। কিছুদিন আগেই সংসদে মহিলা বিল পাশ হয়েছে। তবে তা রূপায়ণ করা হবে ২০২৯ সালে। আগে বিজেপি বলত, দলগুলিই নারীদের বেশি করে প্রার্থী করুক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অন্তত প্রথম তালিকার ক্ষেত্রে তারা খুব বেশি মহিলাকে প্রার্থী করেনি। একদিকে নীতি, অন্যদিকে প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনার মধ্যে তারা দ্বিতীয়টিকেই বেছে নিয়েছে। আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে, সংরক্ষণ ছাড়া লোকসভা ও বিধানসভায় মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর কোনও উপায় নেই।

এই মহিলা নেত্রীদের মধ্যে স্মৃতি ইরানিকে আবার আমেথিতে প্রার্থী করা হয়েছে। কিন্তু আরেক নারী সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমেথিতে স্মৃতিকে প্রার্থী করা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। গতবার তিনি রাহুল গান্ধিকে হারিয়েছিলেন। তারপর তিনি বারবার আমেথি গিয়েছেন, নিজের নির্বাচন ক্ষেত্রের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কি রাহুল আমেথিতে লড়বেন, নাকি, তিনি কেরলের ওয়েনাডেই দাঁড়াবেন, এই প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায়নি।

শশী থারুরের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখরকে প্রার্থী করা হয়েছে। ভালো লড়াই হতে পারে। বিদিশায় শিবরাজ সিং চৌহানকে প্রার্থী করা হয়েছে। কয়েক মাস আগেই মধ্যপ্রদেশে দল জেতার পরেও তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়নি। এবার তাঁকে লোকসভায় নিয়ে আসা হচ্ছে। পরে তাঁকে মন্ত্রী করে সান্ত্বনা পুরস্কার দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকেও লোকসভায় প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি হলেন বিপ্লব দেব। স্পিকার ওম বিড়লাকে আবার কোটা থেকে প্রার্থী করা হয়েছে। ওম বিড়লা যেভাবে লোকসভা চালিয়েছেন, তাতে মোদি-শা’রা সন্তুষ্ট। তবে জিতলে তাঁকে আবার স্পিকার করা হবে কি না তা বলা যাচ্ছে না। কারণ মোদি এইসব ক্ষেত্রে চমক দিতে ভালোবাসেন।

রাজস্থানে বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। তাঁকে এবার আর মুখ্যমন্ত্রী করা হয়নি। তিনি চুপচাপ মেনে নিয়েছেন। তাই তাঁর ছেলে দুষ্মন্ত সিং-কে ঝালাওয়ারে আগের মতোই প্রার্থী করা হয়েছে।

প্রজ্ঞা ঠাকুরকে বাদ দেওয়ার কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, তিনি মোদি-শা’কে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিলেন। তিনি গান্ধিজির হত্যাকারী গডসেকে দেশপ্রেমিক বলে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। রমেশ বিধুরীও বিদায়ি সাংসদ দানিশ আলির বিরুদ্ধে খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন বলে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় সিং-কে প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁর ছেলে কৃষকদের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল। এখন তাঁর ছেলে জেলে আছে। পঞ্জাবে আন্দোলনকারী কৃষকদের দাবি ছিল, অজয় সিং-কে প্রার্থী করা যাবে না। সেই দাবি মানা হয়নি।

ভোজপুরি তারকা গায়ক পবন সিংকে আসানসোলে শত্রুঘ্ন সিনহার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, পবন সিং তাঁর বেশ কিছু মিউজিক ভিডিওতে বাঙালি মহিলাদের অসম্মান করেছেন। এরপরই বিজেপি তাঁকে সরিয়ে দেয়। পবন জানিয়ে দেন, তিনি লড়বেন না। অর্থাৎ, যেখানে ঝুঁকি নেওয়া যায়, সেখানে মোদি-শা ঝুঁকি নিয়ে অজয় সিং-কে দাঁড় করাতে পারেন। আর যেখানে সত্যিই ক্ষতি হবে বলে তাঁরা মনে করেন, সেখানে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেও তাঁকে প্রত্যাহার করে নিতে বেশি সময় নেন না। জয়ের সম্ভাবনা কমে গেলে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা দ্বিধাবোধ করেন না।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

হতাশার মাঝে এক দলের উল্লাস আরও মর্মান্তিক

0
মৌমিতা আলম শুকনো মুখ, নুইয়ে পড়া কাঁধ। চোখ দুটো পুকুরের জলে স্থির। যেন কিছু খুঁজছেন। পিঠে ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি এযাবৎ নিজের রক্ত খুইয়ে জোগাড়...

ছাত্রছাত্রীরা যেন বিস্মৃত চারাগাছ

0
রম্যাণী গোস্বামী দক্ষিণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তর, দমদম থেকে ফুলবাড়ি এই এপ্রিল শেষেই জ্বলছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে। পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় বিভিন্ন আলোচনায় বারবার উঠে আসছে...

Ramban Land Sinking | ধসে যাচ্ছে একের পর এক বাড়ি, রাস্তা! ভূমিধসের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ভূস্বর্গ। জম্মু-কাশ্মীরের রামবান জেলায় (Ramban land sinking) ধসে যাচ্ছে একের পর এক বাড়ি। ফাটল ধরেছে রাস্তাঘাটে। ফলে...
weather update in west bengal

Weather Report | ১ মে পর্যন্ত তাপপ্রবাহ চলবে বঙ্গে, কবে মিলবে স্বস্তির বৃষ্টি?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: তাপপ্রবাহের হাত থেকে এখনই মুক্তি নেই রাজ্যবাসীর। শনিবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছুঁয়েছিল ৪১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আপাতত দক্ষিণবঙ্গে...

Ramayana | রামের বেশে নতুন লুকে রণবীর, সীতার চরিত্রে কে?

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: নতুন ছবির লুক ফাঁস হল রনবীর কাপুরের। শনিবার নীতেশ তিওয়ারির নতুন ছবি ‘রামায়ণ’-এর সেট থেকে রাম-সীতার লুক প্রকাশ্যে এসেছে। ছবিতে...

Most Popular