- অভিজিৎ পাল
আর একটি সরস্বতীপুজো চলে গেল। যে বিষয়টি ভাবায়, তা হল পুজোর পরে দেবী প্রতিমার অনাদর। পুজোর পর অনেকেই দেবী প্রতিমা রাস্তার ধারে ফুটপাথে, গাছের তলায়, বাড়ির দেওয়ালের রেলিংয়ে রেখে দেয়। এ এক সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। পথেঘাটে চলতে গিয়ে কমবেশি আমাদের সবারই এটা চোখে পড়েছে। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র একই ছবি।
আমরা কি বড্ড স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি? আমাদের সংস্কৃতিতে সরস্বতীপুজোর দিন হাতেখড়ি দিয়ে পড়ালেখা শুরু হয়, বই আমাদের কাছে বিদ্যাস্বরূপ। বইতে বিদ্যার বাস। যাঁরা পড়াশোনার মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের কাছে বিদ্যাসাধনা নিরন্তর হওয়া উচিত। অথচ আমরা মনে করি শুধু ওই একদিন বিদ্যার সাধনা করলেই ‘কেল্লা ফতে’। প্রশ্ন জাগে, এত আয়োজন করে পুজো, শেষে সেই প্রতিমাকে নদীতে বা জলাশয়ে বিসর্জন দিতে কেন আলসেমি?
আবার কোথাও কোথাও কিছু অদ্ভুত যুক্তিও শোনা যায়। শাস্ত্রে পূজান্তে বিসর্জনের কথা বলা হলেও অনেকের যুক্তি সরস্বতীকে জলে ভাসালে নাকি বিদ্যা ভেসে চলে যাবে। পড়াশোনা হবে না। অথচ বাংলার সেরা উৎসব দুর্গাপুজোর পর আবার দিব্যি আমরা সরস্বতী সহ সবাইকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি। তাহলে প্রশ্ন, তখন কি বিদ্যা ভেসে যাচ্ছে না? লক্ষ্মী প্রতিমা বিসর্জনের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি। সেখানে নাকি ধনসম্পত্তি ভেসে যাবে!
আসলে বিদ্যা থাকা উচিত অন্তরে। দেবী প্রতিমায় বিদ্যা বা বিদ্যাদেবীর অবস্থান তো প্রতীকী। আর যদি দেবী প্রতিমার কথা বলতে চাই , তবে বলতে হয় দেবী হলেন ঐশ্বর্যময়ী। রাস্তার ধারে প্রতিমা পড়ে থাকলে কয়েকদিন পর সেটি অদ্ভুত রূপ লাভ করে যা দেবীর ঐশ্বর্যের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। যাঁরা সরস্বতী প্রতিমা নদীতে ‘বিসর্জন’ দেবেন না বলেন, তাঁরা হয়তো ‘বিসর্জন’ শব্দটির মর্মার্থই জানেন না। অগ্নি পুরাণের ৬৭তম অধ্যায়ে প্রতিমা বিসর্জন নিয়ে বলা আছে- কাঠের প্রতিমা অগ্নিতে বিসর্জন করা যেতে পারে। আবার রত্ন ও ধাতু দিয়ে তৈরি প্রতিমা সমুদ্রে এবং মাটি ও পাথরের তৈরি প্রতিমা নদীতে বিসর্জন করা উচিত।
দেবীকে তো আমরা মা বলে মনে করি। কোথায় কোনও জায়গায় নিজের মা, বাবা বা পরিবারের কারও পুরোনো ছবি বা তাদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের মতো কাগজগুলিও তো রাস্তার ধারে বা গাছতলায় ফেলে দেন না।
বিদেশে যেখানে নদী দূষণ রোধ করার জন্য প্রতিমা নদীতে বিসর্জন দিতে দেওয়া হয় না, সেখানে পুরোনো প্রতিমা এক বছর যত্নে রক্ষা করা হয় এবং পুজোর আগে সেই প্রতিমাকে নতুনভাবে সাজিয়ে আবার পুজো করা হয়। এই নিয়ম আমাদের দেশেও চালু করা উচিত। এক পুজো উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গত বছর খুব বড় করে এক বড় প্রতিমা দিয়ে তিনি পুজোর আয়োজন করলেন দেখলাম। পুজোর পরে এক সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করলেন। কিন্তু পরে দেখি প্রতিমাটি মাঠে খোলা আকাশের নীচে পড়ে রয়েছে। রোদে বৃষ্টিতে ভিজে যা অবস্থা হওয়ার তাই হল। দেবী তো বিদ্যার পাশাপাশি বুদ্ধি ও জ্ঞানও প্রদান করেন। এবছর তিনি যেন তাঁর ভক্তদের সুবুদ্ধিটুকু দেন।
(লেখক উড়লাজোত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, অম্বিকানগরের বাসিন্দা)